ইতিহাস ফিরিয়ে নিয়ে যায় আবার একশো এক বছর আগে - শুভজিৎ দে

পয়েলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ, বাঙালির নববর্ষ। তাই বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম সর্বজনীন উৎসব হল পয়েলা বৈশাখে 'বাংলা নববর্ষ বরণ উৎসব। বিগত বছরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনার হিসাব চুকিয়ে নতুন বছরের নতুন স্বপ্ন আর সম্ভাবনার মঙ্গল কামনায় এক চিরায়ত উৎসবই বলা যেতে পারে, বাংলা নববর্ষকে তথা পয়েলা বৈশাখের উৎসব আয়োজনকে। তবে বাংলা নববর্ষ বিষয়ে আমি কিছু ইতিহাস ঐতিহ্যের ও বিষাদের দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

চিত্রঋণ গল্প কুটির

1919 সালের সেই মর্মান্তিক ঘটনা, শুধু বাঙালিকে নয়, বরং সারা ভারত জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। সেবার ও নববর্ষকে অতীতের সব বেদনা ভুলে আনন্দে গ্রহণ করতে পারেনি কেউ, বর্তমান পরিস্থিতিও একই রকম, শোকে মুহ্যমান সকলে। কি হয়েছিল একশো বছর আগে 13ই এপ্রিল, যার জন্য সে বছর নববর্ষ উদযাপন ম্লান হয়ে গিয়েছিল, জেনে নেওয়া যাক তবে সেই ঘটনা ।

গতকাল (13ই এপ্রিল) শতবর্ষ অতিক্রম করেছে জালিয়ান ওয়ালাবাগের নিষ্ঠুরতা। যে-কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি সুখস্মৃতি বয়ে আনে, তবে তা মধুর হয় স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু তা যদি না হয়ে সেই স্মৃতি হয় বীভৎসতা, নৃশংসতার বার্তাবহ? তবে তা নিয়ে আলোচনায় আপাত কোন সুখ নেই। ভারতবাসী এবং আপামর শান্তিকামী শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানবতাবাদী জনগণের কাছেই ব্রিটিশ সরকারের এই কাপুরুষতা একাধারে ঘৃণা এবং বিরাগের জন্ম দেয়। ‘কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’ তবুও আজ শতবর্ষ পরে আমাদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয়। তাকাতে হয় এই জন্য যে, মানবতার নির্মম লাঞ্ছনা, যা ভারতবাসী প্রত্যক্ষ করেছিল একশো বছর আগে, লোভী, ক্ষমতাদর্পী, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সেই বর্বরতা থেকে আজও কি মুক্ত হতে পেরেছে ভারতবাসী তথা সমগ্র বিশ্বের নিরপরাধ মানুষ? আজ হয়তো ইংরেজ নেই ভারতবর্ষে, তথাকথিত এই স্বাধীন দেশে হিংস্রতা, অসহিষ্ণুতা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। শুধু আমরা কেন, গোটা বিশ্বই আজ এই সংকটের সামনে অসহায়। কাশ্মীরে পুলওয়ামা হত্যাকাণ্ড সেকথাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আবার এই মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিরুপায় মানুষের হাহাকার একই কথা জানান দেয়। আমার বক্তব্য হল বহুসংখ্যক নিরপরাধ মানুষের ওপর মানুষেরই পাশবিকতার এই ঘটনাক্রম স্তম্ভিত করে, তা যে পরিস্থিতিতে যে ঘটনাক্রমেই ঘটে থাকুক না কেন। কেন আমরা স্মরণ করব সেই দুঃখস্মৃতিকে?

জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ এবং এই নববর্ষ। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তাঁর সেই নাইট-হুড ত্যাগের মাধ্যমেই শুধু তিনি বিরত থাকেন নি। সেই সময়ে এই ঘটনার প্রতিবাদে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিস্পৃহতা তাঁকে ব্যথিত করেছিল। এক্ষেত্রে তিনি একা, ভীষণ একা। নিঃসঙ্গ। তাঁর ভাবনাকে কেউ বোঝেনি সেদিন। অমৃতসর কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি বর্জন ও প্রতিবাদপত্র কংগ্রেসী মহলে এতটকু স্বীকৃতি পায়নি। তথাকথিত রাজনীতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি যুক্ত নন। কিন্তু বাহ্যিক কোনো ঘটনা পরম্পরা রবীন্দ্রনাথের মতো সংবেদনশীল মানুষের মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে পারেনি। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। রাজনীতির মূল্যবোধহীনতা, ধর্মাধর্মজ্ঞান, নীতিবোধ কোথাও যেন কবিকে মানিয়ে বাঁধা দিয়েছে। অথচ যা ঘটে চলে তাকে অস্বীকারই বা করবেন কীভাবে? মানবতাবাদী কবি পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তে মানুষে ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ অজস্রবার, বিভিন্ন মাধ্যমে করেছেন। এ জন্যই তিনি একা, নিঃসঙ্গ।

১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জাতে বিশ্বব্যাপি প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। ভয়াবহ এই মহামারীকে তখন নাম দেওয়া হয় "স্পেনীয় ফ্লু বা স্প্যানিশ ফ্লু"। সারা পৃথিবীর মত তা ভারতেও থাবা ফেলে, বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের আবার একশো বছর আগে নিয়ে গেছে, যেখানে নববর্ষকে আনন্দে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

আজও অনেকেই অনুরোধ করছেন সকলকে ঘরে থাকার জন্য, কারণ সেদিন ঐ ভিড়ের মধ্যে (জালিয়ানওয়ালাবাগে) অনেকেই জানতেন না ঐ স্থানে কি হচ্ছে, আর আজও আমরা ঘরবন্দি থাকতে পারছি না, সেদিন মাইকেল ও ডায়ায়ের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়েছিল মানুষ মারার কাজ, আজ তা করছে একটি মারণ ভাইরাস। ইতিহাস আবার আমাদের অদ্ভূত ভাবে 1919 এর নববর্ষের আগে নিয়ে এলো।


তথ্যসূত্র -
আধুনিক ভারতের রূপান্তর রাজ থেকে স্বরাজ - সমর কুমার মল্লিক
Wikipedia

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে