পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে

ছবি প্রতিকী

এই পেশার জন্মলগ্ন কবে? ইতিহাস তা সঠিকভাবে আমাদের জানাতে পারেনা। তবে এই পেশাকে আদিম বলতে আমি সম্মত নই। আদিম বলতে আমরা যা বুঝে থাকি, সৃষ্টির সূচনা থেকে চলে আসা। তবে এই পতিতাবৃত্তি নতুনও নয়, আবার আদিমও নয়। মনুষ্য জাতির সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে পরিবর্তনের হাওয়ায় তাল মিলিয়ে আমাদের জীবনযাত্রার মান আধুনিকতার দিকে এগিয়ে গেছে, এবং সেখান থেকেই পতিতাবৃত্তি –র সূচনা। গবেষকদের চোখে এমন কোনো দলিল এখনও আসে নি, যার উপর ভিত্তি করে এই পেশাকে আদিম বলা যায়। তবে, যৌনাচার যে ছিল না এমনও নয়। একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, “পতিতাবৃত্তি” পরিপূর্ণ পেশা হিসেবে সমাজ বিবর্তনের বহু পরে শুরু হয়েছে।
এনসাইক্লোপেডিয়া বৃটানিকা গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, “যৌনাচার সমাজে প্রচলিত ছিল এমন সমাজ আদিতে দেখা যায় না।”১ তবে প্রাচীন ভারত, মধ্য প্রাচ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় অদ্ভূত অদ্ভূত কিছু নিয়মের কারনে নারী জাতিকে বহুভোগ্যা হতে হত। উদাহরণ স্বরুপ ভারতীয় শাস্ত্রীয় গ্রন্থ থেকে দ্রপদীর কথা বলা যেতে পারে। যদিও এই বহুভোগ্যা বিষয়টিকে একটি অর্থে বোঝাবার জন্য সরাসরি ‘পতিতাবৃত্তি’ বলা যাবে না। তবে এই ধরনের ‘সমাজ ব্যবস্থা’ –র ফলে অনেক মহিলা পরবর্তীতে পরিত্যক্তা হয়ে দেহদান (দেহব্যবসা) করে পেট চালাত। এই বিষয়টিকেও সরাসরি সংগঠিত আকারে আধুনিক গনিকা ব্যবসার মত বলা যাবে না। কারন তা ছিল নিতান্ত অসংগঠিত ও বিক্ষিপ্ত। সর্বপরি এঁরা ছিলেন সামাজিক কু-প্রথার স্বীকার। এই ব্যবস্থাটিও আদিম নয়, আদতে আদিম কথাটিই এখানে আপেক্ষিক।
মানব জীবনের অস্তিত্ব সাত লক্ষ বছর আগের বলে বৈজ্ঞানিকরা মনে করে থাকেন। কিন্তু সভ্যতার যাত্রা শুরু দেড় লক্ষ বছর আগের বলে জোড়ালো ভাবে মনে করা হয়; সাত লক্ষ বছর আগের কথা বাদ দিলাম, দেড় লক্ষ বছর আগেও যদি পতিতাবৃত্তির অস্তিত্ব পাওয়া যায় তবে তাকে আদিম বলা যাবে। আসলে কিছু সুবিধাপন্থী মানুষ নিজের চাহিদা পূরনের জন্য একটি অসামাজিক সম্পর্ক ও তাকে সমাজ থেকে ব্রাত্য করার জন্য পতিতা বা গনিকা শব্দের ব্যবহার করে একে পেশা দেখাতে চেয়েছেন বলে আমি মনে করি। এত গেল তার (পতিতাবৃত্তি) অস্তিত্ব সম্পর্কিত বিষয়। তবে পতিতা কারা? কেনই বা সমাজ তাদের অন্ধকারে রাখতে চায়? আধুনিকতার বিবর্তনের সাথে সাথে কেনই বা তাদেরকে দেখা (সামাজিক দৃষ্টিকোণে, মান-সন্মানের প্রেক্ষিতে) নিম্নতর হচ্ছে? এই বিষয়ে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। সেই উত্তর পাওয়ার আগে পতিতা কারা? কী ভাবে এই পতিতাবৃত্তির জন্ম হল তা জানা দরকার।
পতিতা কারা? –এ বিষয়ে হয়তো অনেকেই জানেন, -তবুও সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। এখানে ঐতিহাসিক কার (E. H. Carr) –এর উপদেশ প্রনিধানযোগ্য; তিনি বলেছেন যে, “Study the historian, before you begin to study the facts”। সমাজ, পরিজনে পরিতক্তা হয়ে আত্মহননের পথ বেচে না নিয়ে, দেহ বিক্রয়ের বর্তমান ব্যবসায়ীক পোষাকি নাম পতিতাবৃত্তি। লোকমুখে যার আরও অনেক নাম আছে; গনিকাবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি, দেহব্যবসা ইত্যাদি। যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা সমাজের কিছু ‘ভদ্র’ মানুষের যৌন লিপস্যা বা তৃষ্ণা নিবারণ করে তাকে আমরা পতিতালয় বা বেশ্যালয় বলে চিনে থাকি। সমাজের নজড়ে একে অন্ধকার গলি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। হয়তো অন্ধকার বলেই আলোর জগতের মানুষেরা চেনে না এই পথ। খুব সুনির্দিষ্ট করে হয়তো বলা মুশকিল পৃথিবীর ইতিহাসে কখন কীভাবে উৎপত্তি হয়েছে এই বিচিত্র ব্যবসার। তবে যতদূর জানা যায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার গর্ভে অর্থাৎ সামন্তীয় সমাজের ফসল এই পতিতাবৃত্তি। পতিতাদের অসংখ্য নামে ডাকা হয় ইতিহাসের আদি কাল থেকেই, যেমন- দেহপসারিধা, বেশ্যা, রক্ষিতা, উপপত্নী, জারিধা, পুংশলী, অতিত্বরা, বির্জজরা, অসোপু, গনিকা, খানকি –ইত্যাদি। কামসূত্র গ্রন্থের লেখক বাৎস্যায়ন পতিতাদের ৯ –টি ভাগে ভাগ করেছেন আর তা হল –“বেশ্যাবিশেষ প্রকরন – কুম্ভদাসী, পরিচারিকা, কুলটা, স্বৈরিনী, নটি, শিল্পকারিকা, প্রকাশ বিনষ্টা, রুপজীবা এবং গনিকা –এই কয়েকটি বেশ্যা বিশেষ।”৩ (কামসূত্র : চতুর্থ ভাগ-ষষ্ঠ অধ্যায় -২৪) অন্যদিকে পতিতা সম্পর্কে বলা হচ্ছে – “সুগবো যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্ত : শ্রব ই যন্ত পূজা”৪ (ঋকবেদের প্রথম মন্ডলের ১২৬ তম সূক্তের পঞ্চম ঋকে বর্ণিত।) George Ryley Seatt তাঁর ‘A HISTORY OF PROSTITUTION FROM ANTIQUTI to the PRESENT DAY’ –নামক গ্রন্থে পতিতাবৃত্তির সংগা দিয়েছেন এই ভাবে, -“পতিতা অর্থাৎ বেশ্যারা হল সেই সম্প্রদায়ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করতে দিতে, নিজের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জন করে।” তবে তিনি তার বইতে আরও একধরনের পতিতার কথা বলেছেন। যারা অর্থ ছাড়াই যৌন সম্পর্কে ব্রতী হন, তাদের তিনি ‘AMETEUR PROSTITUTES’ অর্থাৎ পেশাহীন পতিতা বলে উল্লেখ করেছেন।
পতিতাবৃত্তির উৎপত্তি সৃষ্টির আদি কাল থেকেই বিশেষত অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রীর ইতিহাস সুপ্রাচীন বলে ওবেস্টার অবিধান মনে করে, তাদের মতে সুমেরিয়ান্দের মধ্যেই প্রথম পতিতার দেখা মেলে। অন্যদিকে ইতিহাসের জনক হেরোডেটাস –এর লেখায় এই পতিতাবৃত্তির নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তৎ একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রেদির মন্দিরে যেতে হত (এখানে প্রনিধানযোগ্য এক জনশ্রুতি হল মেডুশার কাহিনী) এবং সেবাশুশ্রুষার নমুনা হিসেবে একজন বিদেশীর সাথে নাম মাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হত। একই ধরনের পতিতাবৃত্তির চর্চা হত সাইপ্রাসে। এটি ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শররগুলিতেও সংক্রামিত হয়। ইসরায়েলে পতিতাবৃত্তি সাধারন বিষয় হলেও কয়েকজন প্রফেট, যেমন ইজাকেইল –এর বিরুদ্ধাচরন করেন। অন্যদিকে প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সমাজে পতিতারা ছিল স্বাধীন এবং তারা বিশেষ ধরনের পোষাক পরিধান করা ও কর দেবার বিষয় তারা উপযুক্ত ছিল।
জাহেলিয়া যুগে আরবে পতিতাবৃত্তি –সহ আরও অনেক খারাপ কাজ চালু ছিল। ঐতিহাসিক পি. কে. হিট্টি বলেন, ‘মহা নবীর’ আবির্ভাবের একশ বছর আগে আইয়্যামে জাহিলিয়া শুরু হয়। এ যুগে বেশ কিছু কবি অশ্লীল কবিতা রচনা করতো, যা এই সময়ে ছিল স্বাভাবিক। প্রাচীন গ্রীস, এথেন্স ও রোমে বহু বছর আগেই পতিতাবৃত্তি চালু হয়েছিল, এমনকি সে সময় অনেককে বাধ্য করা হত এই পেশায় অংশ নিতে। “ইউস্তিয়ানের স্ত্রী রোমক সম্রাজ্ঞী থেওডোর প্রথম জীবনে বেশ্যা ছিলেন। পৃথিবীতে প্রথম বাশ্যাবৃত্তির পেশায় লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই।”৫ (Thomas A. Meginn, The Economy of Prostitution in the Roman World, 2004) এথেন্সের আইন প্রনেতা ও কবি সোলোম যিনি প্রাচীন গ্রীকের তৎকালীন সাত জন জ্ঞানী লোকের একজন হিসেবে গন্য হতেন। তিনি খ্রীষ্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম বেশ্যালয় স্থাপন করেন।৬ (Cf. Herodotus, Book I, para -199)
চীনে পতিতাবৃত্তির ইতিহাস সুপ্রাচীন ‘Fang Fu Ruan’ তাঁর ‘Sex in China’ বইতে লিখেছেন, ‘yand chi’ চীনের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন পতিতা। তাঁর খদ্দের ছিলেন উচ্চশ্রেনীর ব্যক্তিবর্গ। এছাড়া চীনে TANG (তাং) রাজবংশের অধীনে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বেশ্যাবৃত্তি চালু ছিল।৭ (Sex in China, Fang fu Ruan, Springer Science and Business Media, 31st Oct -1991)
মহাভারতে উল্লেখ আছে, একজন বেশ্যা ভালো প্রকৃতির হলে, উচ্চতর জীবনে পুর্নজন্ম লাভ করতে পারবে। এই জীবিকা সম্পর্কে বোদ্ধ ধর্মেরও একমত। মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক বিখ্যাত মুনি ঋষির নাম পাওয়া যায়, যাঁরা ‘স্বর্গবেশ্যা’ দেখে কার্মাত হয়ে তাদের সাথে যৌন মিলন করেছিলেন। বিশ্যামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ঠ, পরাশর, দীর্ঘতমা –এরাই হলেন সেই সব মুনি। মহাভারতের যুগে অন্যান্য সন্মানজনক বৃত্তিগুলির মধ্যে পতিতাবৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। ঐ কারনে বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ডঃ অতুল সুর বলেছেন “মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল।”৮ (দেবালোক –এর যৌন জীবন)
কামসূত্রের ০৬ –ভার্যাধিকারিক এর ৫৩ নম্বর শ্লোকে আছে “স্বামী যাহাকে প্রচ্ছন্ব ভাবে কামনা করে, তাহার সহিত স্বামীর সঙ্গম করিয়া দিবে ও গোপন করিয়া রাখিবে।” –এ শ্লোক থেকে বোঝা যায় সমাজে অনাচার কোম পর্যায়ে ছিল। তাছাড়া ব্যাৎসায়নের সময় বেশ্যারা আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মত বিয়ে, সন্তান এর জন্মদান, ঘর সংসার করতে পারতেন, তার জন্য বেশ্যাবৃত্তি ত্যাগ করার প্রয়োজন হতনা। কিন্তু বিয়ের পর প্রথম একবছর স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সাথে যৌন মিলন করা নিষিদ্ধ ছিল। বিয়ের একবছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর বেশ্যাবৃত্তিতে আর কোনো বাধা থাকত না।
প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের পধান উপদেষ্টা কৌটিল্য; তাঁর লেখা ‘অর্থশাস্ত্র‘ –থেকে জানা যায়, পতিতা ও পতিতাবৃত্তি সংক্রান্ত ভারতবর্ষের এক চিত্র, আর তা হল –সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সময় কৌটিল্যের হাত ধরে দেহব্যবসা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়। যে শিল্পের নাম ছিল ‘বৈশিক কলা’। ঐ সময় দেহব্যবসা ছিল সন্মানীয় পেশা, জ্ঞানী লোকেরা এ শিল্পের চর্চা করতেন, এবং শিক্ষা দিতেন।৯ (প্রেম ও নৈতিকতা, ডঃ প্রতাপচন্দ্র, কলকাতা, ২০০০) কৌটিল্যের আরেক নাম ছিল চানক্য তিনি প্রচীন ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞান গ্রন্থ অর্থশাস্ত্র -এর রচয়িতা। তাঁর গ্রন্থের মতে দেহব্যবসা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা, পুরোপুরি ঘৃনিত বা গোপন নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এর অনুমোদন করে এবং সংগঠকের ভূমিকা কেন্দ্র নেয়। ঋকবেদ এবং জাতকের কাহিনীতে এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন পন্ডিতগন। কৌটিল্য জানান তখন দেহব্যবসা ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক, নগর জীবনের অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় এটি। রাজকোষের আয়ের যে সব উৎস ছিল তার মধ্যে এটি একটি। ‘দূর্গা” –নামক বিভাগটিতে বেশ্যা, জুয়া খেলা ও আবগারী বিভাগের বিভাগের কথা বলেছেন কৌটিল্য। অর্থশাস্ত্রে গনিকাধক্যের উল্লেখ আছে। তার কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গনিকাদের সংগঠিত ওদেখভাল করা। প্রাচীন গ্রীক পর্যটক (কূটনৈতিক) মেগাস্থিনিস প্রথম মৌর্য শাসক চন্দ্রগুপ্তের সময় ভারতে এসেছিলেন, তিনি তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘ইন্ডিকা’ –তে এক ধরনের পরিদর্শকের কথা বলেছেন, যারা রাজ্যের সকল কার্যকর্মের উপর গনিকাদের সহায়তার নজর রাখতেন, এবং রাজার কাছে গোপনে রিপোর্ট দিতেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে শিকারে এবং আরও অনেক সময় বাজারের সঙ্গে গনিকাদের থাকবার কথা লিখেছেন, গ্রিক লেখকরা। মহাভারতেও গনিকাদের বর্নময় জীবন ও রাজকীয় জাকজমকের বর্ণনা আছে। যেমন উদ্যোগ পর্বে কৌরব পক্ষ্যের বেশ্যাদের কাছে যুদুষ্ঠির শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। কৌরবদের সভায় যুদিষ্ঠির যখন শ্রীকৃষ্ণ –কে শান্তির দূত হিসাবে পাঠান, তখন তাঁকে অভ্যর্থনা জানান গনিকারা, অন্যদিকে রামায়নে দেখা যায় রাম ভরতকে জিজ্ঞাসা করছেন, যে তিনি গনিকা, ঘোড়া, হাতির বিষয়ে সন্তুষ্ট কিনা। জনৈক লেখক হেমচন্দ্রের লেখায় একটি কিংবদন্তীর উল্লেখ আছে। যে রাজা নন্দ গনিকার গর্ভজাত এক নাপিতের সন্তান। বৌধ গ্রন্থগুলিতেও বিখ্যাত গনিকা, অম্বাপালী, সালাবতী, সামা, সুলামা ছাড়াও এমন অনেকের কথা বলা আছে, যারা বুদ্ধিও শিল্প দক্ষতার গুণে সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বৌদ্ধগ্রন্থগুলি থেকে জানা যায়, বোদ্ধের এক শিষ্যকে এক গনিকা আকর্ষন করে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে রাখলেও সেই শিষ্য তার সংযম থেকে একবিন্দুও নড়েননি। বরংচ সেই গনিকা পরবর্তীকালে বৌদ্ধ সন্যাসীনি হন। অর্থাৎ তৎকালীন গনিকা নারীরা সমাজে (রাষ্ট্রে) গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে সন্মান পেতেন এবং সাধারন সভ্য সমাজের প্রতিনিধিরা ছাড়া রাজা ও রাজবংশের মানুষও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
সেসময় আরও এক ধরনের পতিতাবৃত্তি চালু ছিল ভারতে; ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি (Sacred Prostitution)। অর্থাৎ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্যকারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে মিলন, উদাহরন স্বরুপ বলা যেতে পারে কুন্তীর কথা। এই ধরনের কাজে যিনি জড়িত থাকতেন তাকে বলা হত ‘দেবদাসী’। দেবদাসী মন্দিরের সেবিকা। এখনো গোপনে ভারতের অনেক মন্দিরে দেবদাসী প্রথা চালু আছে। এছাড়া উত্তর ভারতে ‘জিপসি’ সম্প্রদায়ের মধ্যে মেয়ে শিশুকে পতিতা বানানোর এক ধরনের প্রথা চালু ছিল। বিহার ও উত্তর প্রদেশে ছিল ‘নায়েক’ পশ্চিম ভারতের গুজরাতে দেহ ও বর্নের পতিতা এবং দাক্ষিনাত্যে ছিল ‘মোহর’ নামক উপজাতীয় পতিতা।১০ (দৈনিক আজাদি, ৪ –ঠা মে, ২০১৩) সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। বানভট্ট তাঁর ‘কাদম্বরী’ –গ্রন্থে লিখেছেন, সেকালে বেশ্যারাই রাজাকে স্নান করাত। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিত। নবম শতকে কূট্টনীমত –গ্রন্থে লিখেছেন, কাশ্মীরের মন্ত্রী ও কবি দামোদর গুপ্ত। বাৎসায়নের কামসূত্রের মত কূট্টনীমত একটি ‘কামশাস্ত্র গ্রন্থ’। এছাড়া মহাকবি কালিদাসের মহাকাব্য গুলিতেও বেশ্যা নারীর উল্লেখ আছে।
ব্রিটিশ আমলের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে কি অবস্থা ছিল ঐ সময়ের। ১৮৫৩ থেকে কলকাতা শহরে ৪০৪৯ টি বেশ্যা গৃহ ছিল। যাতে বাস করতেন ১২,৮১৯ জন যৌনকর্মী। ১৮৬৮ তে ছিল ৩০,০০০ জন, ১৯১১ সালের আদম শুমারী অনুযায়ী ১০,৮১৪ জন যৌনকর্মী ছিল কলকাতায়।১১ (কলকাতার যৌন পল্লী : দেবাশিস বসু, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বার্ষিক সংকলন ৫, ২০০১)। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা হয়তো আরও বাশী হবে। কলকাতার সর্বত্রই বেশ্যালয় ছিল বলে বিনয় ঘোষ তার কলকাতা শহরের ইতিবৃত্তি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বিশেষ করে রামবাগান, সোনাগাছি, মেছোবাজার, সিদ্ধেশ্বরীতলা, হাড়কাটা, চাঁপাতলা প্রভৃতি বেশ্যাদের আখড়া।১২ (পুরনো কলকাতার অন্য সংষ্কৃতি, বিশ্নাথ জোয়ারদার, ২০০৯) শুধুমাত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার একটি এলাকাতেই ৪৩ টি বেশ্যালয়ের মালিক ছিলেন।১৩ (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী, ১৯৬২, সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত) হিন্দুরা মনে করে বেশ্যারা এই সমাজকে নির্মল রাখে, আর সেই কারনে দূর্গাপূজার সময় বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য। দূর্গাপূজার সময় ১০ ধরনের মাটির প্রয়োজন হয়, তার মধ্যে বেশ্যার দরজার মাটি অন্যতম একটি।১৪ (কালিকা পুরানোক্ত দূর্গাপূজা পদ্ধতি, প্রবীর কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং সানন্দা পত্রিকা, ১৮ –ই এপ্রিল ১৯৯১, পৃ-১৯)
আসলে নারীদের সব সময় ভোগের পন্যই মনে করা হয়েছে, তাদের সবসময় অবদমিত করে রাখার চেষ্টা চলেছে। তাই হয়তো স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন নারী কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র নন। ঔপনিবেশিক আমলও এর ব্যতিক্রম ছিল না, সমাজে নেতৃস্থানীয় খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ এই নৈতিক স্থলন থেকে মুক্ত ছিলেন না, বেশ্যাবাজি ছিল বাবু সমাজের সাধারন ঘটনা। সমাজ সংষ্কারক রামমোহন রায়েরও রক্ষিতা ছিল। এমনকি ঐ রক্ষিতার গর্ভে তার একটি সন্তান জন্ম নিয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিতা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন, সাহিত্যিক মীর মোশারফ হোসেন নিয়মিত বেশ্যাপাড়ায় যেতেন, যা তিনি নিজেই তার দিনলিপিতে উল্লেখ করে গেছেন। মরমী কবি হাসান রাজা ও কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চটতোপাধ্যায় নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন।১৫ (অবিদ্যার অন্তঃপুরে নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা, ডঃ আবুল আহাসান চৌধুরী) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পতিতালয়ে যেতেন, নিষিদ্ধপল্লীতে যাওয়ার ফলে তাঁর সিফিলিস (ট্রেপোনেমা পেলিডাম) –এ আক্রান্ত হবার খবর তাঁর জীবদ্দশাতেই বসুমতী পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। শুধু তাই নয় সেই সময় ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে ৬০ শতাংশেরই যৌনরোগ হয়। তাই ইংরেজ সরকার ১৮৬৪ সালে পাশ করলেন ‘CANTONMENT ACT’ আইন। সেনা ছাউনি গুলোতে ইংরেজ সৈন্যদের জন্য তৈরী হল আলাদা বেশ্যালয়। সেখানে যে সব বেশ্যারা আসতেন, তাদের রেজিস্ট্রিযুক্ত পরিচয় পত্র দেওয়া হত। যৌনরোগ থেকে তাদের মুক্তরাখার জন্য ‘লকহসপিটাল’ নামে বিশেষ হাসপাতাল স্থাপন করা হয়, প্রধান সেনা ছাউনিতে।১৬ (The Elusine Language : A transnational Feminist Analysis of European Prostitution in Colonial Bombay –Dr. Ashwini Tanbe)
অভিধানে ‘পতিতা’ শব্দটি থাকলেও ‘পতিত’ নামক কোনো শব্দ নেই, এবং থাকার কথাও নয়। সুতরাং ঐতিহাসিক ভাবে একথা প্রতিষ্ঠিত এবং বাস্তব সত্য এই যে যখন থেকে একবিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়েছে; তখন থেকেই স্ত্রীর পাশাপাশি বেশ্যারও সৃষ্টি হয়েছে। এঙ্গেলস তাঁর ‘পরিবার, ব্যক্তিবর্গ সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ নামক বিশ্ব বিখ্যাত গুন্থে বলেছেন “বেশ্যাদের থেকে সেই স্ত্রীর পার্থক্য কেবল এই যে, সে সাধারন বেশ্যাদের মত রোজ নিজের দেহকে দিন মজুরের মত ভাড়া খাটায় না কিন্তু তার দেহকে সে একেবারেই চিরকালের দাসত্বে বিক্রি করে দেয়।” যাই হোক পতিতাবৃত্তি চলছে লক্ষাধিক বছর আগে থেকে। লক্ষ করার বিষয় এই যে যদিও বা কোনো ধর্মই এই ব্যবস্থাকে দৃড়ভাবে সমর্থন না করে এসেছে। তবুও সময়ের আবর্তে কখনও ক্রীতদাসীর সাথে যৌনকর্ম এর পক্ষে বা নারীর দেহ বিক্রয় করার অর্থ মন্দিরের তহবিলে জমা হওয়ার প্রমান পাওয়া যায়। আর্মেনিয়ার আনাইতিস দেবতার মন্দিরের ক্রীতদাসরা, করিন্থের আফ্রোদিতে দেবতার মন্দিরের ক্রীতদাসরা, ভারতীয় মন্দির সমূহের নর্তকীরা, পোর্তুগীজ বায়াদের নর্তকীরা একসময় ছিল দুনিয়ার সেরা বেশ্যা। এভাবে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী, সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে চলে আসছে পতিতাবৃত্তি। এককথায় বলা যেতে পারে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে নারী ও পুরুষের মাঝে বিরাজমান বৈষম্যের এক চরম শোচনীয় পরিনতির নাম হচ্ছে পতিতাবৃত্তি।

পতিতাবৃত্তির বিবর্তন :

মহম্মদ সিরাজুল ইসলামের পতিতাবৃত্তির কারন ও পতিকার গ্রন্থে পাওয়া যায়, সভ্যতার যাত্রাপথে বহু বহু বছর পরে ভারতে বৈদিক যুগে পতিতাবৃত্তি ছিল বলে কোনোকোনো অনির্ভরযোগ্য প্রাচীন পুস্তক। অবশ্য এধরনের পতিতাবৃত্তি বর্তমান যুগের মতো নয়। রাজদরবারে গনিকা ছাড়াও মন্দিরে দেবদাসী নিয়োগের কথা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়। দেবদাসী প্রথাটি ধর্মীয় ভিত্তিতে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করায় সুন্দরী যুবতীদের কেনাবেচা আইনানুগ হয়। তখন থেকেই সুযোগ সন্ধানীরা এই প্রথার সুযোগ নিয়ে ব্যাভিচার শুরু করে। তৎকালীন ভারতীয় সমাজে নোংরা আচার-আচরন ব্যবস্থার কারনে নারীজাতি অবদমিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত ও ভোগের স্বীকার হয় বিভিন্নভাবে নানা নিয়ম-নিষ্ঠার নাগপাশে। এর পর অবশেষে তাদের ছুড়ে ফেলে দেওয়া হত; চিবিয়ে ফেলে দেওয়া চুইঙ্গামের মতো। অগত্যা তখন তাদের বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া কোনো গতি থাকতো না। দক্ষিন ভারতে এই প্রথা এত জনপ্রিয় ছিল যে, মোক্ষ ও অর্থ লাভের আশায় কেউ কেউ বাইরে থেকে মেয়ে কিনে এনে, অথবা কেউ নিজের কন্যাকে পর্যন্ত মন্দিরে উৎসর্গ করত। রাজপুরুষ ও মন্দিরের উচ্চশ্রেনীর পুরোহিতরা এই নারীদেহ ভোগ করত। রাজপুরুষ ও মন্দিরের উচ্চশ্রেনীর পুরোহিতরা এই নারীদেহ ভোগ করত। এই প্রথা অনেক সময় তা ধর্মীয় বিধিও পাপ  স্খলনের জন্যও হয়ে থাকত। যার সাথে সভাবগত মিল পাওয়া যায় ১৫ শতকের ইউরোপে প্রাক নবজাগরন মুহূর্তে চার্চের ধর্মীয় পাত্রবিলির মত। এই সব দেবদাসীদের জন্য ভালোবাসা বা বিয়ে ছিল মৃত্যু তুল্য অপরাধ মন্দির থেকে একবার এরা বহিষ্কৃত হলে পতিতালয় ছাড়া এদের আর কোথাও জায়গা হত না।
শুনলে অবাক লাগে সে সময় মানুষ কিনা কাজ করেছে, তাও সভ্যতার জন্য নাকি ভোগবিলাসিতের জন্য। এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে বারবার। অমরকোষ গ্রন্থে জয়াজীব বলে এক শ্রেনীর লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়, যে সমাজে পয়সার বিনিময় একজনের স্ত্রীকে অনেকে ভোগ করত। রামায়নে আছে রাম বনবাসে যাওয়ার সময় সীতা সঙ্গে যাওয়ার জন্য যেদ ধরেন, রাম প্রথমে তাকে নিয়ে যেতে অস্বীকার করলে তিনি বলেন “নর্তকেরা যেমন তাদের স্ত্রীদের অন্যভোগ্যা করে, তুমিও আমাকে তাই করতে চাও?” –এখান থেকে চিন্তা করলে অন্যভোগ্যা শব্দটি সম্পর্কে একটি ধারনা জন্মাবে। “বাৎসায়নের কামসূত্রে” চারন কবি সম্প্রদায়ের উল্লেখ করে বলা হয়েছে চারনদের স্ত্রী সহজলভ্যা ছিল। পৌরানিক কাহিনী ও শাস্ত্র গুলো থেকে আরও জানা যায় ‘রাজবাড়ির উৎসবের দিন সিংহ দরজা খুলে দেওয়া হত। বহু রমনী আসত সেখানে, অনেকে কাজে আবার অনেকে উৎসব দেখতে। রাজা তাদেরকে দূর থেকে দেখে পছন্দ করতেন এবং দূত মারফত উপঢৌকনসহ তাকে রাজার শয্যাশায়িনি হবার জন্য আমন্ত্রন পাঠাতেন। স্বেচ্ছায় না এলে, তাকে বলপূর্বক নিয়ে এসে রাজপালংকে ফেলা হত। এক্ষেত্রে তার পরিবার বা স্বামী কিছু বলতে পারতেন না। রাজার দেখা দেখি অমর্ত্যবর্গের কাছেও যে সকল রমনী কাজে আসত, তাদেরকে এইসব উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারীর যৌন সম্ভোগের শিকার হতে হতো। কামসূত্রে আরও উল্লেখ আছে বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, প্রাষিত ভর্তৃকা (যার স্বামী থাকেন) অক্ষমের স্ত্রী ও বাড়ির দাসীকে পুরুষেরা বিভিন্নভাবে ফুসলিয়ে জোর করে ভোগ করতো। যদিও এই সব যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে আইন ছিলনা। বৈদিকোত্তর যুগের চিত্র তুলে ধরেছেন এল. ডি. যোশী, নৈনিতাল আলমোড়া এবং গাড়োয়াল অঞ্চলে দেশীয় রাজাদের অধীনে ‘নাইক’ –নামে এক সম্প্রদায় ছিল। নাইকদের মেয়েরা ঘরের পুরুষদের ভরন-পোষনের জন্য বেশ্যাবৃত্তি গ্রহন করতে বাধ্য হতেন। অনেক সময় অর্থের বিনিময় পুরুষেরা ঘরের মেয়েদের বিক্রি করে দিত। পরবর্তীকালেও যে এই কর্মকান্ড বন্ধ হয়নি তা বোঝা যায় ব্রিটিশ শাসনকালে এই ধরনের কাজ বন্ধ করা হয়। তা সত্ত্বেও চিত্র পরিবর্তন হয়নি, বর্তমান দিনেও বাড়ির মেয়ে বা স্ত্রীকে সোনাগাছিতে বেঁচে দিয়ে যাওয়ার উদাহরণ পাওয়া যায়।
মিসেস গৌরি ব্যানার্জী নম্বুদ্রি সমাজের এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেছেন, নম্বুদ্রি সমাজের কন্যারা থাকতো পর্দার অন্তরালে, কোনো পুরুষ যদি হঠাৎ তাদের দেখে ফেলত কিংবা স্পর্শ করতো, তবে সেই মেয়ে পতিতা বলে গন্য হত সমাজে। প্রথমে সমাজপতিরা মেয়েটিকে সমাজচ্যুত বলে ঘোষনা করে দিলে তার বাড়ির ভৃত্যরা সর্ব প্রথম মেয়েটিকে ভোগ করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসবে। এক্ষেত্রে মেয়েটির বাবা-মা কিছু বলতে পারবে না। পরবর্তীকালে লড়াই করে মেয়েটিকে রাস্তা থেকে যে নিয়ে যেতে পারবে মেয়েটি তার ভোগের পাত্র হবে। এভাবে কিছু হাত ঘোরার পর তাকে বিক্রী বা দান করে দেওয়া হত। অবশেষে মেয়েটি পৌছাতো অন্ধকার জগতে। তখন তার আত্মহত্যা বা পতিতাবৃত্তি ছাড়া সামনে কোনো উপায় থাকতো না।
ডি. এন. মজুমদার হিমালয়ের কোলে উপজাতিদের মধ্যে এক আশ্চর্য প্রথার কথা লিখেছেন, ‘রীত’ –নামক এক প্রথা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি তার প্রথম স্ত্রীকে বিক্রী করে দিতো, সেই অর্থে সে স্বাচ্ছন্দে দ্বিতীয় স্ত্রী সংগ্রহ করতে পারতো এবং তাকেও সে এমনি ভাবে বেঁচে দিতে পারত। এভাবে বেঁচা-কেনার ফলে হাত বদল হতে হতে যৌবন নিঃশেষ হলে পরে তারা আস্তাকুরে নিক্ষিপ্ত হতো, স্থানীয় সরকার স্ত্রী বিক্রয়ের ওপর কর আদায় কর তেন বলে জানা যায়। মহম্মদ সিরাজুল ইসলাম লিখছেন আমাদের বাংলাতেও এক সময় ছিল এরকম এক অদ্ভূত প্রথা, রাজা লক্ষন সেন ছিলেন এই প্রথার উদ্যোক্তা। এই প্রথার নাম ছিল কুলিন প্রথা। ব্রাহ্মন কুলিক পুরুষেরা অর্থের বিনিময়ে ঘরে ঘরে বিয়ে করে বেড়াত। কোনো কোনো কুলিন ব্রাহ্মনের শতাধিক স্ত্রী থাকবার কথা জানা যায়। অনেক যৌবনবতী স্ত্রী স্বামীর সংসর্গ না পেয়ে ব্যাভিচারে লিপ্ত হতো, এ তে সে গর্ভবতী  হয়ে পড়লে কুলিন স্বামী মেয়ের পিতার কাছে সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার করার বিনিময়ে অনেক টাকা আদায় করত। অন্যথায় ব্যাভিচারের অপরাধে মেয়েটিকে সমাজচ্যুত করা হত। বিতাড়িত মেয়েটির সামনে খোলা থাকতো মাত্র দুটি পথ; আত্মহত্যা বা পতিতালয়। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধ থেকে বেশ্যাবৃত্তির চতিত্রের পটপরিবর্ত্ন হতে থাকে, বর্তমান দিনে আমরা যে ভাবে বেশ্যালয় বা বেশ্যাবৃত্তিকে দেখে থাকি, তার সূচনা বা ভাবনার পরিবর্তন এই সময় থেকে ঘটতে থাকে। প্রাচীন শাস্ত্রাদি থেকে জানা যায়, এটি মোটেই আজকের মত ছিল না। বরং বেশ সন্মানজনক একটি পেশা ছিল। কিন্তু মহাভারতের  অশ্বমেধ পর্বে নীলধ্বজের স্ত্রী জনা, পান্ডু পত্নী বা পান্ডব দের মাতা কুন্তী, তার পুত্রবধূ অর্থাৎ দ্রৌপদী এবং হস্তিনাপুরের সম্রাট শান্তনুর দ্বিতীয় স্ত্রী সত্যবতী –কে বেশ্যা বলে মন্তব্য করেছেন, বলে জানা যায় কবি মধুসূদন দত্তের কাব্য থেকে। অতএব কেউ জন্ম থেকেই ভেবে নেয়না সে বাশ্যা হবে। সমাজ ও অর্থনৈতিক সংকট তাকে ঐ পেশা গ্রহন করতে বাধ্য করে; বাধ্য করে সমাজের জটিল রীতি-নীতি। 

উপরন্তু আলোচনার থেকে বোঝা যায়, প্রাচীনকালে পতিতারা সন্মান পেলেও বর্তমান দিনে তারা তার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, শুধু বঞ্চনাই নয়, সমাজ তাদের অপাংক্তেয় হিসেবে মনে করে। এই মনোভাবের পরিবর্তন দরকার। 

তথ্যসূত্র
১।এনসাইক্লোপেডিয়া বৃটানিকা;
২।ই. এইচ. কার, ‘কাকে বলে ইতিহাস’, বাংলা অনুবাদ- কে. পি. বাগচি; 
৩।কামসূত্র : চতুর্থ ভাগ-ষষ্ঠ অধ্যায়;
৪।ঋকবেদের প্রথম মন্ডলের ১২৬ তম সূক্তের প্রথম ঋক;
৫। Thomas A. Meginn, ‘The Economy of Prostitution in the Roman World’, 2004;
৬।The Historians, Book 1, Chapter -199, Herodotus;
৭।Fang Fu Ruan, Sex in China;
৮।ডঃ অতুল সুর, ‘দেবালোক –এর যৌন জীবন’;
৯।ডঃ প্রতাপ চন্দ্র, ‘প্রেম ও নৈতিকতা’;
১০।দৈনিক আজাদি, ৪ –ঠা মে, ২০১৩;
১১।‘কলকাতার যৌনপল্লী’, দেবাশিস বসু, সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত, বাতিক সংকলন ৫, ২০০১;
১২।বিশ্বনাথ জোয়াদার, ‘পুরনো কলকাতার অন্য সংষ্কৃতি’;
১৩।দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী, ১৯৬২, সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত;
১৪।কালিকা পুরানোক্ত দূর্গাপূজা পদ্ধতি, প্রবীর কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং সানন্দা পত্রিকা, ১৮ –ই এপ্রিল ১৯৯১, পৃ-১৯;
১৫।অবিদ্যার অন্তঃপুরে নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা, ডঃ আবুল আহাসান চৌধুরী;
১৬।The Elusine Language : A transnational Feminist Analysis of European Prostitution in Colonial Bombay –Dr. Ashwini Tanbe;

সহায়ক গ্রন্থ
বাৎসায়ন, প্রবাত কামসূত্র, পঞ্চানন তর্করত্ন ও মানবেন্দু বন্দোপাধ্যায়;
কৌটিল্য : প্রেম ও নৈতিকতা, ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র;
কলকাতার যৌনপল্লী, দেবাশিস বসু, সুধীর চক্রবর্তী -সম্পাদিত;
বেশ্যা পাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ, মো ভট্টাচার্য –সম্পাদিত;
পুরনো কলকাতার অন্য সংষ্কৃতি;

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে