আদি থেকে অন্ত জুয়া করেছে সর্বস্বান্ত : সাট্টা - শুভজিৎ দে

'জুআচোর' শব্দটি ধ্বনি সংক্ষেপের ফলে হয়েছে জোচ্চোর। তাতে অবশ্য কোনো রকমের অর্থপরিবর্তন হয়নি, আর বলা বাহুল্য শব্দটির উৎস রয়েছে সেই বেদের আমল থেকে চলে আসা জুয়াখেলা থেকে। এ ছাড়া দুয়ের মধ্যে পার্থক্য বলতে 'জুআচোর' সাধারণত ব্যবহৃত হয় বাক্যে আর জোচ্চোর সংলাপে। জুয়া শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একদল বিষণ্ণ, নিস্তেজ মুখ, আর অন্যদিকে কিছু মানুষের চোখে মুখে খুশির ছাপ, মুখে একগাল হাসি। ছোটোবেলা থেকেই আমরা জুয়া খেলার সাথে পরিচিত, আর সেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে "মহাভারত", 18 দিনের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ মৃত্যু, আত্মীয়র হাতে আত্মীয়র হত্যা সবকিছুর পিছনে ছিল এই জুয়া। পুরা কাল থেকে আধুনিক কাল জুয়া নিজের অবয়ব পরিবর্তন করে দিব্য টিকে আছে, মানুষ যতদিন ভাগ্যে বিশ্বাস করবে, পৃথিবীতে জুয়াও ততদিন টিকে থাকবে।

আধুনিক কালের জুয়া খেলার দৃশ্য

একে অন্যকে ঠকানোর নতুন নতুন তরিকা, শকুনির পাশার ঘুঁটিতে গুবরে পোকা ভরা ছিল তাই শকুনি যে দান বলতেন পাশার ঘুঁটিতে সেই দানই উঠত। সেই লোক ঠকানোর ট্র্যাডিশন আজও অব্যাহত। উনবিংশ শতাব্দীর এক সময় এই তিলোত্তমাও জুয়া খেলার লাসভেগাস হয়ে ওঠে, এখনও কলকাতার আনাচেকানাচে জুয়ার ঠেক বসে, আর কি বিচিত্র তার রকমফের।

মহাভারতের যুগে পাশা খেলার দৃশ্য


সাট্টার ইতিকথা

ষাটের দশকে মুম্বইতে শুরু হয় এই জুয়া খেলা, স্থানীয় নাম 'মটকা' , পরবর্তীতে রতন ছেত্রী নামে এক অন্ধকার জগতের এক বাদশার হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে তা গোটা দেশে, সত্তরের দশকে বাংলার জুয়ারসিক মহলে এই মটকা পরিচিত হয় সাট্টা নামে। চল্লিশের দশকে আমেরিকান মাফিয়াদের আবিষ্কৃত ' নাম্বার গেমের ' আদলে এই খেলা। খেলা হবে দিনে দুবার, কোনো ছুটি নেই, বিশাল একটি এলাকাভিত্তিক ভাবে যারা এই খেলাটি পরিচালনা করেন তাঁকে বলা হয় 'বুকি'। বুকির নীচে থাকেন এজেন্ট, যারা ছোটো ছোটো এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত। এদের নীচে থাকে হাজার হাজার পেনসিলার, পাড়ার মোর বেঞ্চি, অথবা ছোটো পান বিড়ির দোকানে এদের অফিস। গ্রাহকরা খেলতে আসবে পেনসিলারদের কাছে, মুম্বাই থেকে রেজাল্টের খবর প্রথম ফোনে জানবেন বুকি, বুকি থেকে এজেন্ট, এজেন্টদের থেকে খবর পৌঁছে যাবে পেনসিলার দের কাছে।

মুম্বাইয়ের অনুকরণে মধ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিট আর বড়বাজার অঞ্চল থেকে চালু হয় কলাবাগান, ভূতনাথ, ফটাফট নামের সাট্টা। তবে এই কলকাতা জুড়ে সাট্টার ফলাও করবার অনেকটাই ধাক্কা খায় 1993 সালে বউবাজার বোমা মামলায়, মধ্য কলকাতার সাট্টা তথা মুকুটহীন সম্রাট বুকি রশিদ খান, 93 এ বোমার আঘাতে যে বাড়িটি ভেঙে পরে তার মালিক এই রশিদ, শুধু বাড়িই ভেঙে যায়নি, মৃত্যু হয় একাধিক মানুষের, এইজন্য রশিদ কে যেতে হয় শ্রীঘরে, ফলস্বরূপ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় শহরজোড়া রশিদের সাট্টা সাম্রাজ্যের চেন। তার পরেও লুকিয়ে লুকিয়ে চলতে থাকে সাট্টার আসর, রীতিমত সরকারি ট্যাক্স দিয়ে চলতে থাকে 'প্লে উইন', 'সুপার লোটো', আরও নানান নামের জুয়া। সর্বনাশা সুপারলোটোর মোহে আকৃষ্ট হয়ে সর্বস্বান্ত হন বহু মানুষ, বেচে নেন আত্মহননের পথ, অবশেষে 2012 সালে এই মরণ খেলা বন্ধ হয়।

রশিদ খান

এছড়াও আছে, 'মাল কোম্পানিকা', 'লাল বাদাম সাদা বাদাম', 'কি আফ লাক', 'শের ফুল', 'খেলার আড়ালে', 'ভাগ্যের চাকা তো ঘুরছে', 'তাসের দেশ', 'কুইনালা-টানালা-জ্যকপট', নানান রকমফের জুয়া। আর তাতে সব টাকা শেষ, এই রকম পরিস্থিতিতে অনেকেরই মনে পড়ে যায় জুয়াড়ি শীর্ষক সঙের গানে উদাসীন জুয়াড়িরুপী সঙ গাইত -

' ঢোল ভেঙ্গেছে, খোল ভেঙ্গেছে,
নোটের তাড়া তাও নিয়েছে,
ঘোড়ার চালে, চাল চুলো সব,
বিকিয়ে ফিরি বাড়ি,
কানা কড়ি, নেই পকেটে,
কেমনে চড়বো আমি গাড়ী, '

তথ্যসূত্র

কলির শহর কলকাতা- হরিপদ ভৌমিক
কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত - বিনয় ঘোষ
কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা - মহেন্দ্রনাথ দত্ত
কলিকাতা দর্পণ - রাধারমণ মিত্র
শ্রীপান্থের কলকাতা - শ্রীপান্থ
আরেকটা কলকাতা - সুপ্রিয় চৌধুরী

Comments

Post a Comment

If you have any doubt, please let me know.

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে