211 তম জন্মবার্ষিকীতে ডিরোজিও, তবু আজও সে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের আদর্শ - শুভজিৎ দে

হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও আজ থেকে 211 বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন 18ই এপ্রিল, 1809 সালে। তাঁর অল্পবিস্তারিত এ জীবনে তিনি যা করেছিলেন তা আজও আদর্শ হয়ে আছে। পঞ্চদশ শতকের দিকে শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শনের মৌলিক কিছু বিষয় নিয়ে পাশ্চাত্যে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। পাশ্চাত্যের নবজাগরণের ডাক এসেছিল ইতালিতে। এরই ফলশ্রুতি মানুষ সন্ধান করতে চেয়েছিল নতুন জীবনের, উন্মোচিত করতে চেয়েছিল অন্ধকার দূরীকরণের আলোক দ্যুতি। আর এই উন্মেচিত আলোক দ্যুতিই ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নবজাগরণের সৃষ্টি করে।

চিত্রঋণ - Wikipedia

ইউরোপে সৃষ্ট নবজাগরণ বাংলায় আসে এক ইউরোপিয়ানেরই হাত ধরে। তার রক্তে ইউরোপ থাকলেও তিনি নিজেকে দাবি করতেন একজন খাঁটি বাঙালি হিসেবে। বাঙলার জন্য অবাধ-নিরপেক্ষ আমরণ সংগ্রাম তিনি চালিয়েছেন। তিনি আর কেউ নন বাংলার নবজাগরনের পুরোধা পুরুষ, ইয়ংবেঙ্গলের প্রাণপুরুষ হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। বিদেশি শাসকদের শোষণে-নিপীড়িত বাঙালির চিন্তা-চেতনা না পেরেছে স্বাধীনতা অর্জন করতে, না পেরেছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে। আর এই সব সংকট কালীন মুহূর্ত থেকে বাঁচাবার মতো মহান সাধক বাঙালির ভাগ্যে খুব দেরিতে জুটেছে। ডিরোজিও বাংলার মানুষের সেই চিন্তা-চেতনার প্রতিবন্ধকতা দূর করার চেষ্টা করেছেন কুসংস্কার মুক্তু সমাজের স্বপ্ন দিয়ে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমল শেষ হবার সাথে সাথে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। এরপর কিছুদিন ইংরেজদের প্রায় অধীনেই নবাবি করলেন মীর কাশিম। তারপরেই ইংরেজদের প্রত্যক্ষ শাসনে চলে এলো বাঙালিরা, তখনকার ভারতবাসীরা। আর ইংরেজরা প্রবেশ করতে লাগলো ভারতের সর্বক্ষেত্রে। প্রায় সব ইংরেজই যখন কোনো না কোনোভাবে বাঙালিকে হাতিয়ে নিতে চাইছে, এর মধ্যে পশ্চিমা কিছু মানুষ ব্যতিক্রম ছিলেন, যারা বাঙালির উন্নতিই চেয়েছিল। এরই মধ্যে অন্যতম হলেন এই হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও।

আমরা যদি একটু পিছনে দেখি তাহলে দেখতে পাই সমাজ সংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহনের কত খ্যাতি। সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ এবং নারী অধিকার সংরক্ষণসহ তিনি আরো কত সামাজিক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু প্রকৃতার্থে বাঙালির চিন্তায়, সমাজে, রাষ্ট্রে নবজাগরণের সৃষ্টি হয়নি। কারণ তার সংস্কারের প্রচেষ্টা ছিল গণ্ডিবদ্ধ পরিসরে। রাজা রামমোহনের পরবর্তী সময়ে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর নাম এ প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক। নবজাগরণের অর্থ ও তাৎপর্যের বিচারে ডিরোজিওর মাঝে ছিল নবজাগরণের চূড়ান্ত উপলব্ধি। এই উপলব্ধির কারণেই তিনি বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠেছিলেন। চিন্তার স্বাধীনতা ও গণমানুষের স্বাধীনতা অর্জনের নেশায় তিনি বিভোর ছিলেন। নবজাগরণের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘ইয়ংবেঙ্গল সোসাইটি’। প্রকৃত বিচারে বাঙালি নবজাগরণে এই ‘ইয়ংবেঙ্গল সোসাইটি’ ছিল অগ্রগণ্য। আর ডিরোজিও ছিলেন নবজাগরণের প্রকৃত অগ্রদূত।

শিক্ষক হিসেবে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ছাত্রদের মধ্যে এত উৎসাহের সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তার সহায়তায় 1828 সালে তারা ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে তাদের নিজস্ব একটি সাহিত্য ও বিতর্ক সংঘ প্রতিষ্ঠা করে। এ সংঘ শ্রেণিকক্ষের বাধানিষেধের বাইরে ডিরোজিওর পরিচালনায় তরুণদের মনোযোগ আকর্ষণকারী বিভিন্ন বিষয়ে স্বাধীনভাবে আলোচনা করার একটি সাধারণ মিলনস্থানের সংস্থান করে। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন ছিল এক সফল উদ্যোগ এবং মানিকতলার এক বাগান বাড়িতে এর পাক্ষিক সভাগুলি অনুষ্ঠিত হতো। এ সব সভায় বহু ছাত্র এবং কিছু উদারমনা ও জনহিতৈষী ইউরোপীয় ব্যক্তি যোগ দিতেন। এর সাফল্য ছাত্রদের কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় একই ধরনের সংঘ প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করেছিল। 



ডিরোজিওর শিক্ষাবলি ছাত্রদের মধ্যে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয় এবং তারা বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে সন্দেহ ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করে। ডেভিড হিউম ও জেরেমি বেনথামের যুক্তিবাদী দর্শন ও টমাস পেইনের মতো প্রগতিবাদী চিন্তাবিদদের প্রভাবে তারা সবকিছুই যুক্তির মাপকাঠিতে বিচার করতে শুরু করে। ধর্মের প্রতি তাদের মনোভাব ছিল ভল্টেয়ারের মতো। হিন্দু ধর্মকে খোলাখুলিভাবে নিন্দা করতেও তারা ইতস্তত করে নি। ডিরোজিওর শিক্ষাবলি হিন্দু সমাজে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। সমাজ সংস্কার বিষয়ে প্রথাগত চিন্তাধারার বিরুদ্ধে যাওয়ায় হিন্দু কলেজের শিক্ষক পদ থেকে ডিরোজিওকে অপসারণ করার প্রস্তাব রাখা হয়। এই প্রস্তাব 6-1 ভোটে অনুমোদিত হয়। বহিস্কৃত হবার পরে ডিরোজিও অর্থকষ্টে পড়েন। 1831 সালের 26শে ডিসেম্বর তিনি কলেরায় মারা যান। 1831 সালের ডিসেম্বর মাসে ডিরোজিওর আকস্মিক মৃত্যু প্রগতিবাদীদের উদ্দেশ্য সাধনের পথে গুরুতর আঘাত হানে। তবুও এ অসামান্য শিক্ষক তার তরুণ হিন্দু ছাত্রদের বা সহ-যোদ্ধাদের মনে সংস্কারমুক্তির যে চেতনা উদ্দীপ্ত করেছিলেন তা পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।


তথ্যসূত্র

Wikipedia

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে