রমাবাঈ থেকে পণ্ডিতা রমাবাঈ সরস্বতী হয়ে ওঠার কাহিনি : 162 তম জন্মবার্ষিকীতে রমাবাঈ - শুভজিৎ দে

নারী শিক্ষা, নারী মুক্তি, শ্রমিক নিপীড়নের বিরুদ্ধেও তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিল সব সময় সোচ্চার। পুরুষতান্ত্রিক ও কুসংকারাচ্ছন্ন এই সমাজ মেধা, মনন, পরিশ্রম ও সাহসিকতা দিয়ে যুগে যুগে যেসব নারীরা আজকের সামাজিক অবস্থান তৈরি করেছেন, নারীর তথা সমাজের যাত্রা করেছিলেন গতিশীল, পন্ডিতা রমাবাঈ তাদের মধ্যে একজন। আজ তাঁর 162 তম জন্মবার্ষিকী।

চিত্রঋণ - Wikipedia

ভারতের মহারাষ্ট্র নামক রাজ্যের গুণমলের অরণ্যে পন্ডিতা রমাবাঈ জন্মগ্রহণ করেন। রামাবাঈয়ের পিতা অতন্ত শাস্ত্রী একজন শিক্ষিত ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্ত বুদ্ধির একজন সমাজ সংস্কারক। তখন নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল রমাবাঈ-এর পিতা অনন্ত শাস্ত্রী তার বালিকা বধূকে শিক্ষা দানের উদ্যোগ নেয়ার তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজের রোষানলে নিপতিত হন। এই সময় অনন্ত শাস্ত্রী গ্রাম ছেড়ে বনাঞ্চলে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এই নির্বাসিত জীবনে গুণমলের অরণ্যে জন্মগ্রহণ করেন পন্ডিতা রমাবাঈ, 23শে এপ্রিল, 1858  সালে জন্মগ্রহণ করেন। 1877 সালের দুর্ভিক্ষে রামাবাঈয়ের পিতা ও মাতা অনন্ত শাস্ত্রী ও লক্ষী বাঈ উভয়েই মারা যান।

পিতা-মাতার মৃত্যুর পর রামাবাঈ ও তার ভাইকে নিয়ে পিতার পথ ধরেন। নারী শিক্ষা প্রসারের কাজে অগ্রসর হন। তিনি ছিলেন একজন সুবক্তা। 1878 সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে তাঁকে সম্বর্ধনা দিয়ে ' পণ্ডিতা' উপাধি প্রদান করা হলো এবং বিভিন্ন সংস্কৃত গ্রন্থের ব্যাখ্যাতা হিসেবে দেশব্যাপী খ্যাতির জন্য দেওয়া হলো 'সরস্বতী ' উপাধি। রমাবাঈ হলেন " পণ্ডিতা রমাবাঈ সরস্বতী "। সেই সময়কালে একজন ভারতীয় নারীর এমন প্রাপ্তি অভাবনীয় ! কিন্তু এতো জ্ঞানের বিশ্লেষণ, নিয়ত চর্চা তাঁকে যেন এক শূন্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো, নিয়ত এক অশান্তি তাঁকে অনন্ত শূন্যের বেদনার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো। তেমনি ঈশ্বরকেও তিনি অনুভবে পেলেন না। এক প্রচণ্ড সংগ্রামের মধ্যে দুটি ভাইবোন জীবন কাটাচ্ছিলেন। এরই মাঝে তাঁর বড়ভাই গুরুতর অসুস্থ হয়ে একদিন প্রাণত্যাগ করলেন। সারা বিশ্বে রমাবাঈ তখন একা এক নারী। এই সময় কলিকাতা হাইকোর্টের উকিল সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের শূদ্রবর্ণের এক ব্যক্তি বিপিন বিহারী মেধ্বী তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, রমাবাঈ ভাবলেন স্বামী হিসেবে মেধ্বী একজন ভালো ব্যক্তি হবেন ও দায় দায়িত্ব পালন করবেন, এই ভেবেই 13 নভেম্বর, 1880 সালে তাঁদের বিবাহ হয়।

পরবর্তীকালে স্বামীর মৃত্যুর পর রমাবাঈ কলকাতা ছেড়ে পুনায় চলে যান। সেখানে ‘আর্য মহিলা সমাজ’ নামে এক সংগঠন গড়ে তোলেন। ব্রিটিশ ভারতে 1882 সালে শিক্ষা বিষয়ে একটি কমিশন গঠিত হয়। রামাবাঈ এই কমিশনের কাছে, শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, মহিলা স্কুল ইন্সপেক্টর নিয়োগ করা এবং নারীদের চিকিৎসার জন্য মহিলা ডাক্তার প্রয়োজন, তাই মেডিকেল কলেজে মেয়েদের ভর্তি হবার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশ পেশ করেন। এই সুপারিশ তৎকালীন সময় বিপুল আলোড়ণ সৃষ্টি করেন। যার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে লেডী ডাফরিন মেয়েদের মেডিকেল শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেয়ার আন্দোলন করেন। 1883 সালে রমাবাঈ শিক্ষক হিসেবে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ইপিসকোপালিয়ান চার্চে যোগ দেন। এই চার্চের আমন্ত্রণে রমাবাঈ 1886 সালে শিক্ষা লাভের জন্য আমেরিকা গমন করেন। আমেরিকা থেকে ফিরে এসে বম্বেতে তিনি মহারাষ্ট্রের প্রথম কিশোরী বিধবাদের জন্য স্কুল ও হোস্টেল ‘সারদা সদন’ চালু করেন 1889 সালে। পরবর্তীতে তিনি এই সদন বম্বে থেকে পুনায় স্থানান্তরিত করেন এবং সদনের নামে একটি ট্রাষ্টও গঠন করেন। 1920 সাল থেকেই তার শরীর ভাঙ্গতে শুরু করে, এই সময় তিনি তাঁর সব কাজের দায়িত্ব মেয়ে মনোরমাকে বুঝিয়ে দেন, কিন্তু আপনজনদের মৃত্যু শোক তাঁর পিছু ছাড়েনি, তাঁর মেয়ে এই সময় মারা যান, শোকে মুহ্যমান এই সমাজ সংস্কারক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন 5ই এপ্রিল 1922 সালে।


তথ্যসূত্র

Wikipedia

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে