আজকের দিনেই 108 বছর আগে এক সমুদ্রদানবের সলিলসমাধির আখ্যান - শুভজিৎ দে

" Every night in my dreams, I see you, I feel you ..." এই গানটি শোনেন নি, বা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সেই বেহালা বাদকদের কার্যে অবিচল থাকার দৃশ্য মনে পড়ে না এমন মানুষ নেই। ইংরেজি(হলিউড) সিনেমা দেখতে শুরু করেছেন, আর টাইটেনিক দেখেন নি এমন মানুষ বোধহয় খুবই কম, অনেকই হলিউডের সাথে পরিচিত হন এই সিনেমা দিয়ে। তবে এটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত একটি সিনেমা। আজ থেকে ঠিক 108 বছর আগে অর্থাৎ 14ই এপ্রিল রাত 11টা বেজে 40মিনিটে (23 : 40 p.m)  এই সমুদ্রদানব হিমশৈলের সাথে ধাক্কা খেয়ে চিরতরে হারিয়ে যায়। সম্পূর্ণ জাহাজটি ডুবে যায় পরের দিন অর্থাৎ 15ই এপ্রিল রাত 02টো বেজে 20 মিনিটে (02 : 20 a.m.)
আজ জেনে নেওয়া যাক সেই সমুদ্রদানবের কিছু কথা।

চিত্রঋণ - Wikipedia


আরএমএস টাইটানিক একটি ব্রিটিশ যাত্রীবাহী বৃহদাকার সামুদ্রিক জাহাজ ছিল যা 15 এপ্রিল, 1912 সালে জাহাজটির প্রথম সমুদ্রযাত্রায় সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়র্ক সিটি যাওয়ার পথে হিমশৈলের (আইসবার্গের) সঙ্গে সংঘর্ষে উত্তর অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে যায়। এটি ঐ সময়ের সবচেয়ে বৃহৎ আধুনিক ও বিলাসবহুল যাত্রীবাহী জাহাজ ছিল। 

গ্রিক পুরানের শক্তিশালী দেবতা টাইটানের নামানুসারে এই জাহাজের নাম রাখা হয়েছিল ‘টাইটানিক’। তবে এটি আসলে ছিল জাহাজটির সংক্ষিপ্ত নাম।পুরো জাহাজটির নাম ছিল ‘রয়্যাল মেল স্টিমার টাইটানিক’ সংক্ষেপে আরএমএস টাইটানিক (RMS Titanic)।টাইটানিকের নির্মাণকাজ শুরু করা হয় 1907 সালে। পাঁচ বছর পর 1912 সালে জাহাজটির কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। হল্যান্ডের ‘হোয়াইট স্টার লাইন’ কোম্পানি জাহাজটি নির্মাণ করে ব্রিটেনের বেলফাস্টের হারল্যান্ড ওলফ্ শিপইয়ার্ডে। 60 হাজার টন ওজন এবং 275 মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট জাহাজটি নির্মাণ করতে সে সময় খরচ হয়েছিল প্রায় 75 লাখ মার্কিন ডলার। সেসময়, এটিই ছিল সবচেয়ে বিলাসবহুল প্রমোদতরী।জন পীয়ারপন্ট মরগান নামক একজন আমেরিকান ধনকুবের এবং ইন্টারন্যাশনাল মার্কেন্টাইল মেরিন কোং যৌথভাবে এর নির্মাণে অর্থায়ন করে। দৈর্ঘ্যের দিক দিয়ে  টাইটানিক ছিল তিনটি ফুটবল মাঠের সমান লম্বা!

1912 সালের 10 এপ্রিল সাউদাম্পটন থেকে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে টাইটানিক। সে সময় টাইটানিকে মোট যাত্রী ছিল প্রায় 2200 জন এবং কয়েকশ কর্মী। ব্রিটেন থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় যাওয়া সে সময় খুবই বিপজ্জনক ছিল। ছোটোখাটো জাহাজের পক্ষে বলা চলে জীবন বাজি রেখে যাত্রা করা। কেননা হঠাৎ সামুদ্রিক ঝড়- জলোচ্ছ্বাসে পড়ার আশঙ্কা সবসময়ই ছিল। তারপরও এত সংখ্যক যাত্রী সমুদ্রের রোমাঞ্চকর এই ভ্রমণ উপভোগ করার জন্য টাইটানিকের যাত্রী হয়েছিল। টাইটানিকের প্রথম শ্রেণির ভাড়া ছিল 3100 ডলার। আর তৃতীয় শ্রেণির ভাড়া ছিল 32 ডলার।

14ই এপ্রিল দুপুর দুইটার দিকে ‘America’ নামের একটি জাহাজ থেকে রেডিওর মাধ্যমে টাইটানিক জাহাজকে জানায় তাদের যাত্রাপথে সামনে বড় একটি আইসবার্গ রয়েছে। শুধু তাই নয় পরবর্তীতে ‘Mesaba’ নামের আরও একটি জাহাজ থেকে এই একই ধরনের সতর্কবার্তা পাঠানো হয় টাইটানিকে। এ সময় টাইটানিকের রেডিও যোগাযোগের দায়িত্বে ছিলেন জ্যাক পিলিপস ও হ্যারল্ড ব্রীজ। দু’বারই তাদের দুজনের কাছে এই সতর্কবার্তাকে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। তাই তারা এই সতর্কবার্তা টাইটানিকের মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে পাঠান নি। বলা চলে তাদের এই হেয়ালীপনার কারণেই ডুবেছে টাইটানিক।

টাইটানিক যখন দুর্ঘটনা স্থলের প্রায় কাছাকাছি চলে আসে। তখনই জাহাজের ক্যাপ্টেন সামনে আইসবার্গ এর সংকেত পান। আইসবার্গ হল সাগরের বুকে ভাসতে থাকা বিশাল বিশাল সব বরফখণ্ড। এগুলোর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এগুলোর মাত্রই আট ভাগের এক ভাগ জলের উপরে থাকে। মানে, এর বড়ো অংশটাই দেখা যায় না। তখন তিনি জাহাজের গতি সামান্য দক্ষিণ বা বাম দিকে ফিরিয়ে নেন। সে সময় টাইটানিকের পথ পর্যবেক্ষন কারীরা সরাসরি টাইটানিকের সামনে সেই আইসবার্গটি দেখতে পায় কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। টাইটানিকের ফার্স্ট অফিসার মুর্ডক আকস্মিকভাবে বামে মোড় নেওয়ার অর্ডার দেন এবং জাহাজটিকে সম্পূর্ণ উল্টাদিকে চালনা করতে বা বন্ধ করে দিতে বলেন। টাইটানিককে আর বাঁচানো সম্ভব হয় নি। এর ডানদিক আইসবার্গের সাথে প্রচন্ড ঘষা খেয়ে চলতে থাকে। ফলে টাইটানিকের প্রায় 90 মিটার অংশ জুড়ে চিড় দেখা দেয় ও ধীরে ধীরে সে ডুবতে শুরু করে। টাইটানিক জাহাজটি যেই স্থানে ডুবেছিল সেই স্থানের নাম হলো ‘গ্রেট ব্যাংকস অফ নিউফাউন্ডল্যান্ড’।  রাত 2টো 20 মিনিটের মধ্যে টাইটানিকের সম্পূর্ণ অংশ আটলান্তিকের বুকে তলিয়ে যায়। ডুবে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে জাহাজের বৈদ্যুতিক সংযোগ বিকল হয়ে যায়। টাইটানিক যখন সমুদ্রের বুকে তলিয়ে যায় ঠিক তার 1 ঘণ্টা 40 মিনিট পর রাত 4 টে 10 মিনিটে সেখানে আসে ‘দি কারপাথিয়া’ নামের একটি জাহাজ। জাহাজটি সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়ানো 800 জন যাত্রীকে উদ্ধার করে সকাল সাড়ে আটটার দিকে নিউইয়র্কে চলে যায়।

তথ্যসূত্র 

Wikipedia

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে