জন্মদিনে বর্ণপরিচয় 165 বছর বয়েসেও সে আজও শিশুশিক্ষার দিশা - শুভজিৎ দে
আজ থেকে 165 বছর আগে আজকের দিনে পন্ডিত শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয়। যা আজ ও আগামী নব প্রজন্মকেও বর্ণের পরিচয় দিয়ে যাবে ।
বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ
বর্ণপরিচয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত একটি বাংলা বর্ণশিক্ষার প্রাইমারি বা প্রাথমিক পুস্তিকা। দুই ভাগে প্রকাশিত এই পুস্তিকাটির দুটি ভাগই প্রকাশিত হয়েছিল 1855 সালে। দুই পয়সা মূল্যের এই ক্ষীণকায় পুস্তিকার প্রকাশ বাংলার শিক্ষাজগতে ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই পুস্তিকায় বিদ্যাসাগর মহাশয় বাংলা বর্ণমালাকে সংস্কৃত ভাষার অযৌক্তিক শাসনজাল থেকে মুক্ত করেন এবং যুক্তি ও বাস্তবতাবোধের প্রয়োগে এই বর্ণমালার সংস্কার-সাধনে প্রবৃত্ত হন। গ্রন্থটি যে শুধু বিদ্যাসাগরের জীবৎকালেই সমাদৃত হয়েছিল তাই নয়, আজ গ্রন্থপ্রকাশের 165 বছর পরেও এর জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই গ্রন্থটিকে একটি প্রধান প্রথমিক গ্রন্থ হিসাবে অনুমোদন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কলকাতা পৌরসংস্থার যৌথ প্রয়াসে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় ভারতে বৃহত্তম যে বইবাসরটি (বই বিক্রয়ের শপিং মল) নির্মিত হচ্ছে, তার নামও এই গ্রন্থটির সম্মানে বর্ণপরিচয় রাখা হয়েছে।
ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের পূর্বেও ছাপার অক্ষরে এই জাতীয় কিছু কিছু পুস্তিকা বাজারে চলত।” ডক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে রাধাকান্ত দেব রচিত বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ, স্কুল বুক সোসাইটি প্রকাশিত বর্ণমালা প্রথম ভাগ ও বর্ণমালা দ্বিতীয় ভাগ, ক্ষেত্রমোহন দত্ত কর্তৃক তিন ভাগে রচিত শিশুসেবধি, মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত শিশুশিক্ষা গ্রন্থগুলির নাম করেছেন। তবে এই সব পুস্তিকা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। বাংলা বর্ণমালায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার ক্ষমতাও এগুলির রচয়িতাদের ছিল না। ডক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “শোনা যায়, প্যারীচরণ সরকার এবং বিদ্যাসাগর একদা সিদ্ধান্ত করেন যে, দু’জনে ইংরেজি ও বাংলায় বর্ণশিক্ষা বিষয়ক প্রাথমিক পুস্তিকা লিখবেন। তদনুসারে প্যারীচরণ First Book of Reading এবং বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ’ প্রকাশ করেন।” বিহারীলাল সরকারের রচনা থেকে জানা যায় মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পালকিতে বসে পথেই বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন বিদ্যাসাগর। এবং 1855 সালের 13 এপ্রিলে প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয়।
তিনি (বিদ্যাসাগর) এত দিনকার বর্ণমালর সংস্কার করতে চেয়েছিলেন, বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগে তিনি স্বর-ব্যঞ্জন বর্ণ হিসেবে বর্নমালাকে সাজাতে গিয়ে আগে প্রচলিত বহু বর্ণকে স্বরবর্ণ থেকে ব্যঞ্জন বর্ণে এনে স্থান দিয়েছেন। আবার অনেক বর্ণকে সংস্কৃত থেকে এনে বাংলায় স্বতন্ত্র হরফের মর্যাদা দেন। উল্লেখ্য মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের বাংলা বর্ণমালায় সংখ্যা ছিল 48, কিন্তু বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় 52 তে।
এত দিনকার বাল্যশিক্ষায় যে টোলপ্রথা চলে আসছিল তা তিনি অচল করতে চেয়েছিলেন, তিনি তাঁর স্কুল মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটের শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন কোনো ছাত্রের সাথে অপমানজনক ব্যবহার না করা হয়, এ কারণেই আমরা হয়তো বর্ণপরিচয়ের মধ্যে উপদেশ, নীতিকথা, উচিত অনুচিতের প্রভেদটা খুব পরিস্কার ভাবে বুঝতে পারি।
বর্ণপরিচয়ের প্রয়োজনীয়তা, সর্বজনীনতা ও ব্যপকতার চূড়ান্ত বৈশিষ্ট্য হল এই যে বর্ণপরিচয় সস্তা নিউজ প্রিন্টে ছাপা হয়ে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, হাটে, মুদির দোকানে, ফেরিওয়ালার ঝুড়িতে সমানে বিক্রি হয়েছিল শিশুশিক্ষার মূখ্য বই হিসেবে। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়অর্ধে তর্কালঙ্কার মহাশয়ের শিশু শিক্ষার সাথে, বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের এক অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়, 1890 সালে যে খানে শিশু শিক্ষার 149 টি সংস্করণ প্রয়োজন হয়, সেখানে বর্ণপরিচয়ের দরকার পরে 152 টি সংস্করণ। শিশু শিক্ষাকে চিরতরে পিছনে ফেলে দেয় বর্ণপরিচয়। সেই শুরু 165 বছর পরেও সেই ট্রাডিশন সামনে চলছে।
তথ্যসূত্র ও ঋণ স্বীকার :-
বিদ্যাসাগর থেকে বেগম রোকেয়া শিশুশিক্ষার সারথি - কাজী সুফিউর রহমান
Wikipedia
Anek kichu janlam
ReplyDelete