মৃত্যু কে জয় করে ফিরে আসার আখ্যান : ফিনিক্স পাখি - শুভজিৎ দে
অজানা কে জানার, অচেনা কে চেনার সুপ্ত বাসনা আমাদের সকলেরই আছে, আর এখানেই অনেকের প্রশ্ন যদি মৃত্যুর পর কি হয় দেখা যেত! না এমন কোনো উপায় এখনও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে কথায় আছে না বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, আর তর্কে বহুদূর। ঠিক তেমনই, বিজ্ঞান এমন কোনো উপায় বাতলাতে না পাড়লেও, পুরণ তা পেরেছে। শুধু এ দেশে নয়, পৃথিবীর বহু দেশে বহু সভ্যতায় এর বর্ণনা আছে নানা ভাবে, যে মৃত্যু কে জয় করে আবার ফিরে আসে, আর মৃত্যুকে জয় করে ফিরে আসা প্রাণীটি হচ্ছে ফিনিক্স পাখি। অনেকেই ফিনিক্স পাখির নাম পর্যন্ত শোনেননি বা ফিনিক্স পাখির সম্পর্কে জানেন না। তাদের জন্য ছোট করে ফিনিক্স পাখির ধারণা দিতে চাই। আমরা পৌরাণিক কাহিনী থেকে ফিনিক্স পাখি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবো। ফিনিক্স পাখি সম্পর্কে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে, বিভিন্ন জনশ্রুতির কথা বলা হয়েছে। বর্তমান প্রজন্ম হয়তো ফিনিক্স পাখিকে বুঝবে না, তবে এই প্রজন্মের প্রেমের সম্পর্কের সাথে এই পাখির দারুণ মিল, সেই মিল বোঝাতে কবিতার দুটি লাইন উদাহরণ স্বরূপ বলাই যায় -
" প্রেম যে ফিনিক্স পাখি,
আগুন নিয়ে বেড়ায় বুকে,
জমরাজ আসার আগেই,
আগুন জ্বালায় নিজের সুখে। "
এবার ফেরা যাক ফিনিক্স প্রসঙ্গে। পুরাণে নানারকম আশ্চর্য পশু পাখির সন্ধান মেলে। এ ধরনের জীব জন্তুর ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ আজও কল্পনা ছাড়িয়ে যায়। কাল্পনিক হলেও বৈশিষ্ট্যের কারণে এগুলো আজও মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে বেঁচে আছে । এমনই একটি আকর্ষণীয় পৌরাণিক চরিত্র ফিনিক্স পাখি।
আমরা যারা জানি, ফিনিক্স পাখির কথা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে আগুন রঙা একটি পাখি যেটি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ঘর বাঁধে। এর পরে নিজেই আগুন ধরিরে দেয় নিজের ঘরে। ঘর সহ শরীর পুড়ে ছাই হয়ে যায় ফিনিক্স পাখির। এখানেই শেষ নয় সেইসব ভস্মীভূত ছাই থেকে জেগে উঠে আরেকটি অগ্নিবর্ণ ফিনিক্স পাখি। প্রচলিত লোককাহিনী মতে, ফিনিক্স পাখিকে হিংসুকেরা আঘাত করলে এর পালক থেকেও জন্ম নেয় নতুন প্রাণ। এদের চোখের জলও বদলে দিতে পারে কারও জীবন। অগ্নি ও পবিত্রতার দৌলতে এরা মৃত্যু পথযাত্রীদেরও সাময়িক জীবন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
প্রাচীন গ্রীক ও রোমক বইপত্রে ফিনিক্সের উল্লেখ এসেছে বারংবার। কিন্তু কেমন পাখি এই ফিনিক্স? কীরকম তার চেহারা? "এদেশে একরকম পাখিও আছে যার নাম ফিনিক্স, যাকে ভারী পবিত্র বলে মনে করা হয়" – মিশর সম্পর্কে লিখছেন হেরোডোটাস, তাঁর ইতিহাস বইতে। মিশরের পশুপাখির বিস্তৃত বিবরণ দিতে গিয়ে খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের এই ঐতিহাসিক, যাঁকে ইতিহাসের জনক বলা হয়, তিনি বলছিলেন "এদেশে ভোঁদড় হল পবিত্র প্রাণী। তেমনি নীলনদের দু’টি মাছকে সবাই ভক্তি করে – লেপিডোটাস আর ঈল। আর পাখিদের মধ্যে হংসগোত্রীয় দু’টি পাখি। সেরকমই, ফিনিক্স। আমি তাকে কখনও দেখিনি, ছবিতে ছাড়া। তার আকার ঈগলের মত, পালক লাল ও সোনালি। "
ফিনিক্স পাখির কথা আগে থেকে জানলেও সম্প্রতি নতুনভাবে আমাদের সামনে চলে আসে হ্যারি পটার সিরিজের কল্যানে। হ্যারি পটার সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে লেখিকা জে কে রোলিং আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন টুকটুকে লাল এক পোষা ফিনিক্স পাখির, যার অশ্রুজলে সুস্থ হয়ে ওঠে মৃত্যুপথযাত্রী হ্যারি। হ্যারি পটার এন্ড দা অর্ডার অফ দা ফিনিক্স (Harry potter and the Order of the phoenix ) দেখার সময় একটা পর্যায়ে দেখবেন একটা পাখি নিজেই আগুনে পুড়ে ছাই গেল। অবাক করা বিষয় হচ্ছে সেই ছাই থেকে আবার পাখিটি পুর্নজন্ম লাভ করেছে ! আশ্বর্যজনক ব্যাপার ! প্রফেসর, হ্যারি পটারের সাথে পাখিটিকে ফিনিক্স নামে পরিচয় করিয়ে দেন।
প্রথম ফিনিক্স পাখির কল্পনা করেছিল ফিনিশিয় সভ্যতা। তবে অন্যান্য সভ্যতাতেও অনুরুপ পাখির সন্ধান মেলে। ফিনিসীয় পুরাণ (বর্তমান লেবানন, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, ইসরাইল) ব্যতিত চাইনিজ পুরাণ, গ্রিক পুরাণ এবং প্রাচীন মিসরীয়দের বর্ণনায়ও ফিনিক্স পাখির উল্লেখ পাওয়া যায়।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে আজও মিশরীয় সভ্যতা স্থান দখল করে আছে। প্রাচীন মিশরে ফিনিক্স ছিল বেনু পাখি নামে। হলুদ, কমলা, লাল আর সোনালি - হরেক রকমের মিশেলে রাঙা এক স্বপ্নিল পাখি বেনু। আবার কোথাও উল্লেখ আছে, ধূসর, নীল, বেগুনী ও সাদার মিশেল হিসেবে। কেউ বলে বেনু বাঁচত ৫০০ বছর আবার কেউ বলত হাজার বছরের উপরে। যত বছরই বাঁচত না কেন সেই সময় পরে জমদূত আসার আগে নিজেই নিজের বানানো আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যেত। সেই ছাই থেকে পুনরায় জন্মাত শিশু ফিনিক্স। বেনু শব্দের অর্থই হলো আগুন থেকে 'সুন্দর করে বেরিয়ে আসা'।
এক পুরাণে বলা আছে, মিসরীয় দেবতা অসাইরিসের হৃদয় থেকে জন্ম নেয় ফিনিক্স পাখি। অন্য পুরাণে অবশ্য বলা আছে, রা' দেবতার মন্দিরের পবিত্র গাছের গায়ে লাগানো আগুন থেকে জন্ম ফিনিক্সের। সে মন্দিরের পবিত্র স্তম্ভ বেনবেন পাথরের উপর বাস করত ফিনিক্স। মারা যাবার সময় এলে, সিনামন গাছের ডগাগুলো যোগাড় করে সেগুলো তার ঘরে রেখে আগুন ধরিয়ে দিত। সেই আগুনে ছাই হয়ে যেত ফিনিক্স পাখি। আর এরপর যা হবার তাই হতো- ছাই থেকে জন্ম হতো এক নতুন ফিনিক্সের।
নীল নদের শুকিয়ে যাওয়া ও আবার জলপূর্ণ হয়ে ওঠার সাথে মিসরীয়রা ফিনিক্স পাখির মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মিল খুঁজে পেত। নীল নদের প্লাবনের সময় নীল রঙের সুন্দর এই পাখিটি আশ্রয় নেয় উঁচু জায়গায়। তখন মনে হয় জলেতে সূর্য ভাসছে। এই কারণে এ পাখির নাম হয়েছে ‘উদিত জন’ বা ‘দি অ্যাসেন্ডিং ওয়ান’ মানে, যা উঠছে, যা মনে করিয়ে দেয় সূর্য দেবতা ' রা ' কে। এত সুন্দর পাখি আর এত সুন্দর তার কন্ঠস্বর যে সূর্যও নাকি সে গান শোনার জন্য থেমে যেত।
পারস্য সভ্যতা অনুসারে ফিনিক্স পাখিকে আমরা হুমা নামে পাই। হুমা মানে হল স্বর্গের পাখি। এ সভ্যতার মানুষেরাও বিশ্বাস করত হুম পাখি শত শত বছর বেঁচে থাকার পরে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যেত। পরে আবার সেই ছাই থেকে তার জন্ম হত। ধরনা করা হত ফিনিক্সে পাখি একই সাথে পুরুষ ও স্ত্রী স্বত্ত্বা বহন করত। এক পাখা ও এক পা হলো পুরুষের, অন্য পা ও পাখা হলো নারীর। ফিনিক্স পাখি কখনো কোনো প্রাণী হত্যা করত না, বরং মৃত পশুর মাংস খেত। বিশ্বাস করা হতো, ফিনিক্সের ছায়ায় কেউ দাঁড়ালে তার জন্য সৌভাগ্য অপেক্ষা করছে। এমনও বিশ্বাস করা হতো যদি ফিনিক্স পাখি মাথায় বসে তাহলে আপনি একদিন রাজা হবেন।
প্রাচীন গ্রিক পুরাণ অনুসারে ফিনিক্স হল এক পবিত্র "আগুনপাখি"। গ্রিক ভাষায় phoenix মানে 'দি ব্রিলিয়ান্ট ওয়ান' কিংবা লাল এবং নীলের মিশ্রণে সৃষ্ট রং। প্রাচীন মিথ অনুসারে ওই আগুনরঙা ফিনিক্স পাখিটি নাকি ৫০০ বছর বেঁচে থাকত। গ্রিকরা বিশ্বাস করত, এই পাখি আরবে বাস করে। প্রতি ভোরে, ফিনিক্স তার বাসস্থানের পাশের এক কুয়া বা জলাশয়ের জলে যখন স্নান করে এবং সূর্য দেবতা তখন তার রথ থামাতেন ফিনিক্সের গান শোনানের জন্য। অন্য সব পুরানের মত, জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পাখিটি দারুচিনি, গন্ধরস প্রভৃতি সুগন্ধী উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি করত একটি ঘর, তারপর সে ঘরে ধরিয়ে দিত আগুন। ঘরসহ ফিনিক্স পাখিটি পুড়ে ছাই হয়ে যেত। কিন্তু এখানেই সব শেষ নয়, কারণ ভস্মিভূত ছাই থেকে আবার জেগে উঠত আরেকটি অগ্নিবর্ণ ফিনিক্স পাখি।
রোমান চিত্রকলায় ফিনিক্স ঈগলরূপে প্রতিষ্ঠা পায়। পারস্যের লোককাহিনী অনুযায়ী মহাবীর রুস্তমের বাবা জাল এই প্রতীক পাখিকে সযত্নে লালন করেছিলেন। গৃহহীন এই পাখিকে তিনি পেয়েছিলেন আলব্রুজ পাহাড়ে। লেবানন তাদের প্রাচীন এবং আধুনিক সংস্কৃতির প্রধান বাহক মনে করে ফিনিক্সকে।
অনেকে সংস্কৃত উচ্চারণে 'গরুঢ়' পাখিকে ফিনিক্স পাখির সাথে মিল খুঁজে পান। রামায়ণে এর উল্লেখে পাওয়া যায়। গরুদ হলো দেবতা বিষ্ণুর বাহন। আর চীন দেশে ফিনিক্স পাখি ফেংহুয়াং নামে পরিচিত। রাশিয়ার ফায়ারবার্ড, জাপানিজ হোও পাখি, স্থানীয় অ্যামেরিকানদের থান্ডারবার্ডের সাথে ফিনিক্সের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ইহুদি পুরাণে মিলহাম পাখি বা হল পাখি ফিনিক্স নামে পরিচিত। ইহুদীদের বিশ্বাস অনুসারে, আদাম যখন স্বর্গে ছিলেন তখন শয়তানের ছলনায় পড়ে তিনি নিষিদ্ধ কোনো ফল খান। তখন নাকি তিনি খুব দুঃখিত হন এবং ঈর্ষান্বিত হয়ে স্বর্গের অন্য সকল প্রাণীকেও সেই ফল খাওয়ান। কিন্ত সে সময় মিলহাম (ফিনিক্স) বলে কেউ সেটি খায় নি। ফলে ঈশ্বর মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকে মরণশীল প্রাণী হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেও ফিনিক্স পাখির (মিলহাম) উপর খুশি হয়ে তাকে অমরত্ব দান করেন ।
খুবই আকর্ষণীয় এই ফিনিক্সের কাহিনী আর এভাবেই জন্ম-জন্মান্তরের কাহিনী ফিনিক্স পাখিকে নিয়ে চলেছ, আর ফিনিক্স পাখি যখন বুঝতো তার সময় ফুরিয়ে এসেছে তখন নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতো, এবং যখন ভস্মীভূত হতো মানে যখন ছাই হয়ে যেতো, সেই ছাই থেকে নতুন করে আবার পুজম্ম লাভ করতো ফিনিক্স পাখি। নতুন করে আবার জীবন অতিবাহিত করতো।
তথ্যসূত্র
WIKIPEDIA
ফিনিক্স - মহম্মদ জাফর ইকবাল
চিত্রঋণ - Wikipedia
আমরা যারা জানি, ফিনিক্স পাখির কথা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে আগুন রঙা একটি পাখি যেটি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ঘর বাঁধে। এর পরে নিজেই আগুন ধরিরে দেয় নিজের ঘরে। ঘর সহ শরীর পুড়ে ছাই হয়ে যায় ফিনিক্স পাখির। এখানেই শেষ নয় সেইসব ভস্মীভূত ছাই থেকে জেগে উঠে আরেকটি অগ্নিবর্ণ ফিনিক্স পাখি। প্রচলিত লোককাহিনী মতে, ফিনিক্স পাখিকে হিংসুকেরা আঘাত করলে এর পালক থেকেও জন্ম নেয় নতুন প্রাণ। এদের চোখের জলও বদলে দিতে পারে কারও জীবন। অগ্নি ও পবিত্রতার দৌলতে এরা মৃত্যু পথযাত্রীদেরও সাময়িক জীবন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
প্রাচীন গ্রীক ও রোমক বইপত্রে ফিনিক্সের উল্লেখ এসেছে বারংবার। কিন্তু কেমন পাখি এই ফিনিক্স? কীরকম তার চেহারা? "এদেশে একরকম পাখিও আছে যার নাম ফিনিক্স, যাকে ভারী পবিত্র বলে মনে করা হয়" – মিশর সম্পর্কে লিখছেন হেরোডোটাস, তাঁর ইতিহাস বইতে। মিশরের পশুপাখির বিস্তৃত বিবরণ দিতে গিয়ে খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের এই ঐতিহাসিক, যাঁকে ইতিহাসের জনক বলা হয়, তিনি বলছিলেন "এদেশে ভোঁদড় হল পবিত্র প্রাণী। তেমনি নীলনদের দু’টি মাছকে সবাই ভক্তি করে – লেপিডোটাস আর ঈল। আর পাখিদের মধ্যে হংসগোত্রীয় দু’টি পাখি। সেরকমই, ফিনিক্স। আমি তাকে কখনও দেখিনি, ছবিতে ছাড়া। তার আকার ঈগলের মত, পালক লাল ও সোনালি। "
ফিনিক্স পাখির কথা আগে থেকে জানলেও সম্প্রতি নতুনভাবে আমাদের সামনে চলে আসে হ্যারি পটার সিরিজের কল্যানে। হ্যারি পটার সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে লেখিকা জে কে রোলিং আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন টুকটুকে লাল এক পোষা ফিনিক্স পাখির, যার অশ্রুজলে সুস্থ হয়ে ওঠে মৃত্যুপথযাত্রী হ্যারি। হ্যারি পটার এন্ড দা অর্ডার অফ দা ফিনিক্স (Harry potter and the Order of the phoenix ) দেখার সময় একটা পর্যায়ে দেখবেন একটা পাখি নিজেই আগুনে পুড়ে ছাই গেল। অবাক করা বিষয় হচ্ছে সেই ছাই থেকে আবার পাখিটি পুর্নজন্ম লাভ করেছে ! আশ্বর্যজনক ব্যাপার ! প্রফেসর, হ্যারি পটারের সাথে পাখিটিকে ফিনিক্স নামে পরিচয় করিয়ে দেন।
প্রথম ফিনিক্স পাখির কল্পনা করেছিল ফিনিশিয় সভ্যতা। তবে অন্যান্য সভ্যতাতেও অনুরুপ পাখির সন্ধান মেলে। ফিনিসীয় পুরাণ (বর্তমান লেবানন, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, ইসরাইল) ব্যতিত চাইনিজ পুরাণ, গ্রিক পুরাণ এবং প্রাচীন মিসরীয়দের বর্ণনায়ও ফিনিক্স পাখির উল্লেখ পাওয়া যায়।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে আজও মিশরীয় সভ্যতা স্থান দখল করে আছে। প্রাচীন মিশরে ফিনিক্স ছিল বেনু পাখি নামে। হলুদ, কমলা, লাল আর সোনালি - হরেক রকমের মিশেলে রাঙা এক স্বপ্নিল পাখি বেনু। আবার কোথাও উল্লেখ আছে, ধূসর, নীল, বেগুনী ও সাদার মিশেল হিসেবে। কেউ বলে বেনু বাঁচত ৫০০ বছর আবার কেউ বলত হাজার বছরের উপরে। যত বছরই বাঁচত না কেন সেই সময় পরে জমদূত আসার আগে নিজেই নিজের বানানো আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যেত। সেই ছাই থেকে পুনরায় জন্মাত শিশু ফিনিক্স। বেনু শব্দের অর্থই হলো আগুন থেকে 'সুন্দর করে বেরিয়ে আসা'।
এক পুরাণে বলা আছে, মিসরীয় দেবতা অসাইরিসের হৃদয় থেকে জন্ম নেয় ফিনিক্স পাখি। অন্য পুরাণে অবশ্য বলা আছে, রা' দেবতার মন্দিরের পবিত্র গাছের গায়ে লাগানো আগুন থেকে জন্ম ফিনিক্সের। সে মন্দিরের পবিত্র স্তম্ভ বেনবেন পাথরের উপর বাস করত ফিনিক্স। মারা যাবার সময় এলে, সিনামন গাছের ডগাগুলো যোগাড় করে সেগুলো তার ঘরে রেখে আগুন ধরিয়ে দিত। সেই আগুনে ছাই হয়ে যেত ফিনিক্স পাখি। আর এরপর যা হবার তাই হতো- ছাই থেকে জন্ম হতো এক নতুন ফিনিক্সের।
নীল নদের শুকিয়ে যাওয়া ও আবার জলপূর্ণ হয়ে ওঠার সাথে মিসরীয়রা ফিনিক্স পাখির মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মিল খুঁজে পেত। নীল নদের প্লাবনের সময় নীল রঙের সুন্দর এই পাখিটি আশ্রয় নেয় উঁচু জায়গায়। তখন মনে হয় জলেতে সূর্য ভাসছে। এই কারণে এ পাখির নাম হয়েছে ‘উদিত জন’ বা ‘দি অ্যাসেন্ডিং ওয়ান’ মানে, যা উঠছে, যা মনে করিয়ে দেয় সূর্য দেবতা ' রা ' কে। এত সুন্দর পাখি আর এত সুন্দর তার কন্ঠস্বর যে সূর্যও নাকি সে গান শোনার জন্য থেমে যেত।
পারস্য সভ্যতা অনুসারে ফিনিক্স পাখিকে আমরা হুমা নামে পাই। হুমা মানে হল স্বর্গের পাখি। এ সভ্যতার মানুষেরাও বিশ্বাস করত হুম পাখি শত শত বছর বেঁচে থাকার পরে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যেত। পরে আবার সেই ছাই থেকে তার জন্ম হত। ধরনা করা হত ফিনিক্সে পাখি একই সাথে পুরুষ ও স্ত্রী স্বত্ত্বা বহন করত। এক পাখা ও এক পা হলো পুরুষের, অন্য পা ও পাখা হলো নারীর। ফিনিক্স পাখি কখনো কোনো প্রাণী হত্যা করত না, বরং মৃত পশুর মাংস খেত। বিশ্বাস করা হতো, ফিনিক্সের ছায়ায় কেউ দাঁড়ালে তার জন্য সৌভাগ্য অপেক্ষা করছে। এমনও বিশ্বাস করা হতো যদি ফিনিক্স পাখি মাথায় বসে তাহলে আপনি একদিন রাজা হবেন।
প্রাচীন গ্রিক পুরাণ অনুসারে ফিনিক্স হল এক পবিত্র "আগুনপাখি"। গ্রিক ভাষায় phoenix মানে 'দি ব্রিলিয়ান্ট ওয়ান' কিংবা লাল এবং নীলের মিশ্রণে সৃষ্ট রং। প্রাচীন মিথ অনুসারে ওই আগুনরঙা ফিনিক্স পাখিটি নাকি ৫০০ বছর বেঁচে থাকত। গ্রিকরা বিশ্বাস করত, এই পাখি আরবে বাস করে। প্রতি ভোরে, ফিনিক্স তার বাসস্থানের পাশের এক কুয়া বা জলাশয়ের জলে যখন স্নান করে এবং সূর্য দেবতা তখন তার রথ থামাতেন ফিনিক্সের গান শোনানের জন্য। অন্য সব পুরানের মত, জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পাখিটি দারুচিনি, গন্ধরস প্রভৃতি সুগন্ধী উদ্ভিদ দিয়ে তৈরি করত একটি ঘর, তারপর সে ঘরে ধরিয়ে দিত আগুন। ঘরসহ ফিনিক্স পাখিটি পুড়ে ছাই হয়ে যেত। কিন্তু এখানেই সব শেষ নয়, কারণ ভস্মিভূত ছাই থেকে আবার জেগে উঠত আরেকটি অগ্নিবর্ণ ফিনিক্স পাখি।
রোমান চিত্রকলায় ফিনিক্স ঈগলরূপে প্রতিষ্ঠা পায়। পারস্যের লোককাহিনী অনুযায়ী মহাবীর রুস্তমের বাবা জাল এই প্রতীক পাখিকে সযত্নে লালন করেছিলেন। গৃহহীন এই পাখিকে তিনি পেয়েছিলেন আলব্রুজ পাহাড়ে। লেবানন তাদের প্রাচীন এবং আধুনিক সংস্কৃতির প্রধান বাহক মনে করে ফিনিক্সকে।
অনেকে সংস্কৃত উচ্চারণে 'গরুঢ়' পাখিকে ফিনিক্স পাখির সাথে মিল খুঁজে পান। রামায়ণে এর উল্লেখে পাওয়া যায়। গরুদ হলো দেবতা বিষ্ণুর বাহন। আর চীন দেশে ফিনিক্স পাখি ফেংহুয়াং নামে পরিচিত। রাশিয়ার ফায়ারবার্ড, জাপানিজ হোও পাখি, স্থানীয় অ্যামেরিকানদের থান্ডারবার্ডের সাথে ফিনিক্সের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ইহুদি পুরাণে মিলহাম পাখি বা হল পাখি ফিনিক্স নামে পরিচিত। ইহুদীদের বিশ্বাস অনুসারে, আদাম যখন স্বর্গে ছিলেন তখন শয়তানের ছলনায় পড়ে তিনি নিষিদ্ধ কোনো ফল খান। তখন নাকি তিনি খুব দুঃখিত হন এবং ঈর্ষান্বিত হয়ে স্বর্গের অন্য সকল প্রাণীকেও সেই ফল খাওয়ান। কিন্ত সে সময় মিলহাম (ফিনিক্স) বলে কেউ সেটি খায় নি। ফলে ঈশ্বর মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকে মরণশীল প্রাণী হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেও ফিনিক্স পাখির (মিলহাম) উপর খুশি হয়ে তাকে অমরত্ব দান করেন ।
চিত্রঋণ - Wikipedia
খুবই আকর্ষণীয় এই ফিনিক্সের কাহিনী আর এভাবেই জন্ম-জন্মান্তরের কাহিনী ফিনিক্স পাখিকে নিয়ে চলেছ, আর ফিনিক্স পাখি যখন বুঝতো তার সময় ফুরিয়ে এসেছে তখন নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতো, এবং যখন ভস্মীভূত হতো মানে যখন ছাই হয়ে যেতো, সেই ছাই থেকে নতুন করে আবার পুজম্ম লাভ করতো ফিনিক্স পাখি। নতুন করে আবার জীবন অতিবাহিত করতো।
তথ্যসূত্র
WIKIPEDIA
ফিনিক্স - মহম্মদ জাফর ইকবাল
Comments
Post a Comment
If you have any doubt, please let me know.