সুকান্ত ছেড়ে গেছেন তিয়াত্তর বছর হল - শুভজিৎ দে
সুকান্ত ভট্টাচার্য
চিত্রঋণ - Wikipedia
তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লিখেছিলেন,
" এখন ও আমার মনে তোমার উজ্বল উপস্থিতি,
প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি।
এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি,
নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রুকুটি। "
এই একই কথা ওনার স্মরণে আমিও বললাম, আমার সাথে সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রথম পরিচয় ঘটায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের " অবাক পৃথিবী " ও " রানার " গানটি। অতঃপর 2008 সালে হাতে পাই সুকান্ত সমগ্র। সেই বাচ্ছা ছেলেটির মন কখন যে জয় করে নিয়েছেন সুকান্তর লেখা তা আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারিনি। 1926 সালে 15ই আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন, রবীন্দ্রউত্তর যুগের এই কবি। পৃথিবীতে তাঁর অবস্থান মাত্র একুশ (21) বছর, আর এই স্বল্প পরিসরে তিনি তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ এমন ভাবে ঘটিয়েছিলেন যা বর্তমান অবস্থাকে ভাবিত করবেই, তিনি সার্থক ভাবেই হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের কবি। বামপন্থী-মার্কসবাদী মনোভাবাপন্ন ঐ তরুন কিশোরের লেখায় ফুটে উঠে ছিল সমাজতন্ত্রী সমাজের নানা দিক। তিনি খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলতেন কবিতার মাধ্যমে। তাই হয়তো তিনি লিখে গেছেন সিঁড়ি, কলম অথবা রানারের মতো অনেকের কথা। বিবৃতিতে তিনি লিখেছেন-
" আমার সোনার দেশে অবশেষে মন্বন্তর নামে,
জমে ভিড় ভ্রষ্টনীড় নগরে ও গ্রামে,
দুর্ভিক্ষের জীবন্ত মিছিল,
প্রত্যেক নিরন্ন প্রাণে বয়ে আনে অনিবার্য মিল। "
এ যেন অনেকটা বর্তমান পরিস্থিতির কথা ফুটে উঠেছে কবিতায়।
এ প্রজন্ম কিশোর সুকান্ত কে চিনবে না, তারা জাস্টিন বিবারে আচ্ছন্ন। পপ সঙ্গীতে মেতে, তাদের কাছে কিশোর কবি সুকান্ত বড়ই ব্যাকডেটেড, কিন্তু যারা জানেন, যারা বোঝেন সুকান্তকে তারা বলবেন অন্য কথা। এই 21 বছর সময়সীমার মধ্যে তিনি নিজেকে মানবতাবাদী ও সাম্যবাদী, বিপ্লবী এবং জীবনধর্মী কবি হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটাই তাঁর সবথেকে বড় কৃতিত্ব। তার কবিত্ব শক্তির দ্বীপ্তিতে সমকালীন ও পরবর্তীকালের পাঠক সমালোচকেরা বিস্মিত হয়েছেন। স্বল্পায়ু জীবনে সর্বহারা শ্রমজীবী মানুষের সপক্ষে কবিতাকে ধারালো অস্ত্র করে ধারণ করেছেন তিনি, কিশোর বয়েসেই ভাষা এবং ছন্দের দক্ষতায় প্রশ্নাতীত কৃতিত্ব অর্জন করেন। রাজনৈতিক দর্শনের প্রতি তাঁর ছিল বলিষ্ঠ ও একনিষ্ঠ বিশ্বাস।
তিনি সর্বদা এক সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন, যা তার ছাড়পত্র কবিতায় ফুটে ওঠে,
" ... তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। "
আবার প্রার্থী নামক কবিতায় তিনি সূর্যকে আহ্বান জানিয়েছেন ভেদাভেদ দূর করার জন্য, -
" হে সূর্য! শীতের সূর্য!
হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়
আমরা থাকি,
যেমন প্রতীক্ষা ক'রে থাকে কৃষকদের চঞ্চল চোখ,
ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলির জন্যে। "
একটি মোরগের কাহিনী কবিতার মাধ্যমে তিনি বিত্তশালী লোকজনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন -
" তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল,
একেবারে সোজা চলে এল
ধব্ধবে সাদা দামী কাপড়ে
ঢাকা খাবার টেবিলে ;
অবশ্য খাবার খেতে নয়
খাবার হিসেবে! "
অথবা সিঁড়ি -
" আমরা সিঁড়ি,
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে;
তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক
পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন। "
অর্থসামাজিক বৈসাদৃশ্য নিয়েও তিনি বিত্তশালী লোকজনের বিরুদ্ধতা করে লিখেছিলেন -
" বলতে পারো বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?
বড়মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি-মিষ্টি,
গরীবরা পায় খোলামকুচি, একি অনাসৃষ্টি?"
আগেই বলা হয়েছে আমার সাথে সুকান্ত ভট্টাচার্যের পরিচয় করিয়ে দেয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তাঁর কন্ঠে সুকান্তের একাধিক গান গীতায়িত হয়েছে, যার আবেদন চিরকালীন, যেমন ' ঠিকানা'। ঠিকানার কথা কি ভোলা সম্ভব হবে কোনোদিনও ? কবি লিখছেন
" ঠিকানা আমার চেয়েছে বন্ধু ঠিকানার সন্ধান,
আজও পাওনি? দুঃখ যে দিলে করব না অভিমান।"
সত্যি আমরা হয়তো ভুল পথেই ঠিকানার সন্ধান করেছি, তাই হয়তো স্বাধীন হয়েও আমরা নিজেদের কাছেই পরাধীন রয়েছি। আর আমরা যে ভুল ঠিকানার সন্ধানই করছি তা তিনি অনেক আগেই আঁচ করেছিলেন,
" অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।
অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন।
অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন;
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো–
দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো। "
তাঁর লেখা আমার সব থেকে প্রিয় কবিতা 'রানার' যেখানে তিনি গ্রাম বাংলার শ্রমজীবী মানুষের কথা তাদের লোভহীন সততার কথা উল্লেখ করেছেন সেখানে -
"... রানার! রানার!
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?
ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে।
কত চিঠি লেখে লোকে- কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে।
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,
এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ,
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে।
দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি, -
এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি-
রানার! রানার! কি হবে এ বোঝা ব'য়ে?
কি হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে?
রানার!রানার ! ভোর তো হয়েছে- আকাশ হয়েছে লাল
আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?
রানার! গ্রামের রানার!
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;
শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ
ভীরুতা পিছনে ফেলে-
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর
অগ্রগতির 'মেলে',
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি-
নেই, দেরি নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে
দুর্দম, হে রানার। "
আবার কখনও প্রকৃতি তন্ময়তায় তার কলম লিখে গেছে,
" এখানে বৃষ্টিমুখর লাজুক গাঁয়ে
এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা।
সবুজ মাঠেরা পথ দেয় পায়ে পায়ে
পথ নেই তবু এখানে যে পথ বাঁধা। "
অবশেষে 1946 সালে তিনি মারাত্মক যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন এবং অজেকের দিনে অর্থাৎ 13ই মে 1947 সালে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ইহলোক ত্যাগ করে চলে যান। কিশোর বয়েসে মারা গেলেও তাঁর দূরদর্শিতা প্রণিধানযোগ্য যা তাঁর মৃত্যু ও স্বাধীনতার তিয়াত্তর বছর পরও একই অবস্থায় রয়েছে,
" ভেজাল, ভেজাল ভেজাল রে ভাই,
ভেজাল সারা দেশটায়,
ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিষ মিলবে নাকো চেষ্টায়!
ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল,
ভেজাল ঘি আর ময়দা,
`কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া,
ভেজালসে হ্যায় ফয়দা।’
ভেজাল পোশাক ভেজাল খাবার,
ভেজাল লোকের ভাবনা,
ভেজালেরই রাজত্ব এ পাটনা থেকে পাবনা।
ভেজাল কথা— বাংলাতে ইংরেজী ভেজাল চলছে,
ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে।
`খাঁটি জিনিষ’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে,
`ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে।
কলিতে ভাই `ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই,
ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই। "
তথ্যসূত্র
সুকান্ত সমগ্র - সুকান্ত ভট্টাচার্য (পৃথ্বীরাজ সেন, সম্পা.)
Comments
Post a Comment
If you have any doubt, please let me know.