খিদিরপুরে সৈয়দ বাবার দরগা ও তাকে ঘিরে জনশ্রুতি - শুভজিৎ দে
কলকাতায় যারা থাকি তারা কোনো না কোনো সময় এর পাশ থেকে গেছেন অবশ্যই। খিদিরপুর থেকে কিছুটা এগালেই পড়বে হেস্টিংস চারমাথার মোর, যার বাম দিকের রাস্তাটি চলেগেছে বাবুঘাট, স্ট্যান্ড রোড, ফুল বাজারের পাশ দিয়ে সোজা হাওড়া। আর ডান দিকের রাস্তাটি চলে গেছে পিজি হাসপাতাল ও রবীন্দ্র সদনের দিকে এবং সামনের রাস্তাটি এগিয়ে চলেছে রেস গ্রাউন্ড, মেয়ো রোড হয়ে ধর্মতলার দিকে। আর এই রাস্তাটা ধরে একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে সৈয়দ বাবার দরগা বামদিকে। চলন্ত গাড়ি থেকে আপনি যদি লক্ষ্য করতে পারেন দেখবেন সৈয়দ বাবার দরগাকে মাঝে রেখে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর একটি শাখা উঠেছে। আপনি সেই শাখা বা RAMP ব্যবহার করে দ্বিতীয় হুগলি সেতু অথবা রবীন্দ্র সদনের দিকে যেতে পারেন, যেকোনো একদিকে যেতে গেলে চোখে পড়বে সাদা-সবুজ রঙের সেই দরগা ও তার গম্বুজ। যার উঠানে সব সময় চলে পায়রাদের আসর। আর এখান দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর পথে প্রায় সকলেই মনে মনে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। এই দরগাকে কেন্দ্র করে রয়েছে বহু জনশ্রুতি, অনেকেই তা বিশ্বাস করেন, আবার অনেকে করেন না।
কে এই সৈয়দ বাবা ? এ প্রশ্ন হতেই পারে, এই সৈয়দ বাবার পুরোনাম সৈয়দ আলী শাহ, যাঁর জন্ম আরবে। ভারতে মুসলমান শাসন শুরু হবার পর তিনি এদেশে আসেন, তবে ঠিক কবে এ বিষয়ে ইতিহাস এখনও চুপ। অতঃপর তার এই পূর্ণ জীবন প্রায় আজ থেকে 327 বছর আগে শেষ হয়। যতদূর জানা যায় তিনি প্রায় একশো বছরের কিছু বেশি সময় জীবিত ছিলেন, আর এখানেই অর্থাৎ বর্তমান খিদিরপুরের হেস্টিংস অঞ্চলেই তিনি তাঁর দেহত্যাগ করেন 1117 হিজিরী সালে (ইংরেজি 1696)। এই কলের কলকাতার মাঝে হেস্টিংসের কাছে দ্বীপের মত দাঁড়িয়ে আছে শান্তি ও পবিত্রতায় ঘেরা সৈয়দ বাবার দরগা, আধুনিকতার ছন্দে থেকে একটু মনসংযোগ করলে বোঝা যাবে এক শান্তির পরিমণ্ডল।
কলকাতায় মন্দির-মসজিদ-গির্জার কমতি নেই, আর সেই সবের থেকে একটু আলাদা এই সৈয়দ বাবার দরগা হলেও অনেকের নজরে পড়ে না, আসা যাওয়ার পথে অনেকেই মনের খেয়ালে চলে আসেন লক্ষ না করেই। কিন্তু একবার যদি আপনার নজর পড়ে তবে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য আপনার মনে ইচ্ছা হবেই অন্ততপক্ষে একবার দরগায় যাওয়ার। এমন সুন্দর স্থান কলকাতায় খুব কম আছে। যেখানে চারিদিকে কংক্রিটের দৌরাত্ব আর সেখানে তার মাঝেই একটুকরো প্রকৃতি। হেস্টিংস মোর থেকে এক মিনিটের রাস্তা, আগে যখন ধর্মতলায় কবাডি খেলার প্রশিক্ষণ নিতে যেতাম, ফেরার পথে বন্ধুরা মিলে কয়েকবার এই দরগায় গিয়েছিলাম, তার পর থেকে আর যাওয়া হয়নি তেমন, ঐ যাতায়াতের পথে যতটুকু দেখা। দরগায় প্রবেশ করলে দেখবেন, এক দিকে ঝুড়িনামা বটগাছ, যার চারিদিকে অগুনিত ক্লান্ত মানুষ, আর পরম নিশ্চিন্তে উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাত-আটশো পায়রা। বটগাছ তাদের স্থায়ী আস্তানা। পুণ্যার্থীরা এখানে এসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন পায়রাদের খাবার খাওয়াতে।
একটু এগালেই দেখবেন সৈয়দ বাবার সমাধি, আর অন্যপাশে বিশ্রামঘর। সৈয়দ বাবা সমাধিতে উত্তর দিকে মাথা করে সমাধিস্ত আছেন, তাঁর ইচ্ছাতেই সমাধির উপর কেবল মাটির প্রলেপ দেওয়া আজও। ভক্তরা সেটি নানা ফুলে সুসজ্জিত করে দেন প্রতিদিন, সমাধির চারিদিকে তোরণ ও তাতে কোরানের বাণী খোদাই করা। শহরের কেন্দ্রবিন্দুর (ধর্মতলা) কাছেই অবস্থিত হওয়ায় প্রায় সব সময়ই এখানে ভক্তসমাগম ঘটে।
এই দরগাকে কেন্দ্র করে রয়েছে বেশ কিছু জনশ্রুতি। যেমন জানা যায় এক দাঙ্গার সময় নাকি ইংরেজ সেনাবাহিনী প্রায় সময় এখানে এসে ঝামেলা করতে থাকতেন নানা অছিলায়, তারা কখনও বলতেন, এখানে সৈয়দ বাবার সমাধি রাখা যাবে না, তা তুলে দিতে হবে। আবার কখনও কখনও বলতেন তারা নামাজ ও আজান দেওয়া যাবে না, এই নিয়ে সৈয়দ বাবার ভক্তগণ ও ইংরেজ সেনার মধ্যে বেশ কিছুদিন বাকবিতণ্ডা চলে, অতঃপর একদিন নাকি দরগার উপর দিয়ে ব্রিটিশ উড়োজাহাজ যাওয়ার সময় আগুন ধরে তা হটাৎ ভেঙে পড়ে, সৈয়দ বাবার ভক্তরা বলে থাকেন সৈয়দ বাবাই এই শাস্তি দিয়েছেন। এই ঘটনার পর থেকে ব্রিটিশ সেনাও দরগা নিয়ে কোনো কথা বলেনি। আবার অন্যদিকে শোনা যায় বিদ্যাসাগর সেতু (দ্বিতীয় হুগলী সেতু) খিদিরপুরগামী শাখা বা RAMP তৈরী করা সম্ভব হচ্ছিনা দরগার উপর দিয়ে, যতবারই পরিকল্পনা করা হয়েছে ততবারই তা ভেস্তে গেছে। পরবর্তিকালে দরগাকে সম্মান জানিয়ে এই দরগাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এই শাখা বা RAMP (বর্তমান অবস্থা) যা এখন স্বাভাবিক ভাবেই আছে। এখানেও অনেকে বলেন সেতুর পূর্ব পরিকল্পনা ছিল সৈয়দ বাবার সমাধির উপর দিয়ে, যেটা তৈরী হলে নাকি তার নিদ্রাভঙ্গ হত। তাই তিনিই নাকি বার বার বাধা সৃষ্টি করে সেই পরিকল্পনা বাতিল করিয়ে দিতেন। অনেকেই হয়তো এই সব জনশ্রুতি মানবেন না, কিন্তু ঐযে কথায় আছে না, বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। ঠিক তেমনই মানা না মানা সবটাই আপনার বিশ্বাসের উপর।
প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার দরগার সামনে মেলা বসে। এছাড়া প্রতি বছর নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে দুইদিন ধরে খুব বড় করে মেলা হয়। সৈয়দ বাবার উরস (সুফিসাধক দের মৃত্যুবার্ষিকী) উপলক্ষে 26 ও 27শে জুমাদা-আল-আওয়াল বা JUMADA-AL-AWAL (আরবীয় ক্যালেন্ডারের পঞ্চম মাস, ইংরেজি অনুযায়ী মার্চ বা এপ্রিল)-এ মহাউৎসব হয়ে থাকে।
গল্প কথায় শুনুন
https://youtu.be/QYwiSfWFCrI
তথ্যসূত্র
Wikipedia
অচেনা এই কলকতা - রমাপদ চৌধুরী (সম্পা.)
কলকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা - মহেন্দ্রনাথ দত্ত
লোকমুখে প্রচলিত জনশ্রুতি
চিত্রঋণ - Wikipedia
কে এই সৈয়দ বাবা ? এ প্রশ্ন হতেই পারে, এই সৈয়দ বাবার পুরোনাম সৈয়দ আলী শাহ, যাঁর জন্ম আরবে। ভারতে মুসলমান শাসন শুরু হবার পর তিনি এদেশে আসেন, তবে ঠিক কবে এ বিষয়ে ইতিহাস এখনও চুপ। অতঃপর তার এই পূর্ণ জীবন প্রায় আজ থেকে 327 বছর আগে শেষ হয়। যতদূর জানা যায় তিনি প্রায় একশো বছরের কিছু বেশি সময় জীবিত ছিলেন, আর এখানেই অর্থাৎ বর্তমান খিদিরপুরের হেস্টিংস অঞ্চলেই তিনি তাঁর দেহত্যাগ করেন 1117 হিজিরী সালে (ইংরেজি 1696)। এই কলের কলকাতার মাঝে হেস্টিংসের কাছে দ্বীপের মত দাঁড়িয়ে আছে শান্তি ও পবিত্রতায় ঘেরা সৈয়দ বাবার দরগা, আধুনিকতার ছন্দে থেকে একটু মনসংযোগ করলে বোঝা যাবে এক শান্তির পরিমণ্ডল।
কলকাতায় মন্দির-মসজিদ-গির্জার কমতি নেই, আর সেই সবের থেকে একটু আলাদা এই সৈয়দ বাবার দরগা হলেও অনেকের নজরে পড়ে না, আসা যাওয়ার পথে অনেকেই মনের খেয়ালে চলে আসেন লক্ষ না করেই। কিন্তু একবার যদি আপনার নজর পড়ে তবে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য আপনার মনে ইচ্ছা হবেই অন্ততপক্ষে একবার দরগায় যাওয়ার। এমন সুন্দর স্থান কলকাতায় খুব কম আছে। যেখানে চারিদিকে কংক্রিটের দৌরাত্ব আর সেখানে তার মাঝেই একটুকরো প্রকৃতি। হেস্টিংস মোর থেকে এক মিনিটের রাস্তা, আগে যখন ধর্মতলায় কবাডি খেলার প্রশিক্ষণ নিতে যেতাম, ফেরার পথে বন্ধুরা মিলে কয়েকবার এই দরগায় গিয়েছিলাম, তার পর থেকে আর যাওয়া হয়নি তেমন, ঐ যাতায়াতের পথে যতটুকু দেখা। দরগায় প্রবেশ করলে দেখবেন, এক দিকে ঝুড়িনামা বটগাছ, যার চারিদিকে অগুনিত ক্লান্ত মানুষ, আর পরম নিশ্চিন্তে উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাত-আটশো পায়রা। বটগাছ তাদের স্থায়ী আস্তানা। পুণ্যার্থীরা এখানে এসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন পায়রাদের খাবার খাওয়াতে।
একটু এগালেই দেখবেন সৈয়দ বাবার সমাধি, আর অন্যপাশে বিশ্রামঘর। সৈয়দ বাবা সমাধিতে উত্তর দিকে মাথা করে সমাধিস্ত আছেন, তাঁর ইচ্ছাতেই সমাধির উপর কেবল মাটির প্রলেপ দেওয়া আজও। ভক্তরা সেটি নানা ফুলে সুসজ্জিত করে দেন প্রতিদিন, সমাধির চারিদিকে তোরণ ও তাতে কোরানের বাণী খোদাই করা। শহরের কেন্দ্রবিন্দুর (ধর্মতলা) কাছেই অবস্থিত হওয়ায় প্রায় সব সময়ই এখানে ভক্তসমাগম ঘটে।
এই দরগাকে কেন্দ্র করে রয়েছে বেশ কিছু জনশ্রুতি। যেমন জানা যায় এক দাঙ্গার সময় নাকি ইংরেজ সেনাবাহিনী প্রায় সময় এখানে এসে ঝামেলা করতে থাকতেন নানা অছিলায়, তারা কখনও বলতেন, এখানে সৈয়দ বাবার সমাধি রাখা যাবে না, তা তুলে দিতে হবে। আবার কখনও কখনও বলতেন তারা নামাজ ও আজান দেওয়া যাবে না, এই নিয়ে সৈয়দ বাবার ভক্তগণ ও ইংরেজ সেনার মধ্যে বেশ কিছুদিন বাকবিতণ্ডা চলে, অতঃপর একদিন নাকি দরগার উপর দিয়ে ব্রিটিশ উড়োজাহাজ যাওয়ার সময় আগুন ধরে তা হটাৎ ভেঙে পড়ে, সৈয়দ বাবার ভক্তরা বলে থাকেন সৈয়দ বাবাই এই শাস্তি দিয়েছেন। এই ঘটনার পর থেকে ব্রিটিশ সেনাও দরগা নিয়ে কোনো কথা বলেনি। আবার অন্যদিকে শোনা যায় বিদ্যাসাগর সেতু (দ্বিতীয় হুগলী সেতু) খিদিরপুরগামী শাখা বা RAMP তৈরী করা সম্ভব হচ্ছিনা দরগার উপর দিয়ে, যতবারই পরিকল্পনা করা হয়েছে ততবারই তা ভেস্তে গেছে। পরবর্তিকালে দরগাকে সম্মান জানিয়ে এই দরগাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এই শাখা বা RAMP (বর্তমান অবস্থা) যা এখন স্বাভাবিক ভাবেই আছে। এখানেও অনেকে বলেন সেতুর পূর্ব পরিকল্পনা ছিল সৈয়দ বাবার সমাধির উপর দিয়ে, যেটা তৈরী হলে নাকি তার নিদ্রাভঙ্গ হত। তাই তিনিই নাকি বার বার বাধা সৃষ্টি করে সেই পরিকল্পনা বাতিল করিয়ে দিতেন। অনেকেই হয়তো এই সব জনশ্রুতি মানবেন না, কিন্তু ঐযে কথায় আছে না, বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। ঠিক তেমনই মানা না মানা সবটাই আপনার বিশ্বাসের উপর।
প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার দরগার সামনে মেলা বসে। এছাড়া প্রতি বছর নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে দুইদিন ধরে খুব বড় করে মেলা হয়। সৈয়দ বাবার উরস (সুফিসাধক দের মৃত্যুবার্ষিকী) উপলক্ষে 26 ও 27শে জুমাদা-আল-আওয়াল বা JUMADA-AL-AWAL (আরবীয় ক্যালেন্ডারের পঞ্চম মাস, ইংরেজি অনুযায়ী মার্চ বা এপ্রিল)-এ মহাউৎসব হয়ে থাকে।
গল্প কথায় শুনুন
https://youtu.be/QYwiSfWFCrI
তথ্যসূত্র
Wikipedia
অচেনা এই কলকতা - রমাপদ চৌধুরী (সম্পা.)
কলকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা - মহেন্দ্রনাথ দত্ত
লোকমুখে প্রচলিত জনশ্রুতি
Comments
Post a Comment
If you have any doubt, please let me know.