শতবর্ষ যায়, শতবর্ষ আসে, ইতিহাস একই পথে নিরন্তর ঘুরতে থাকে - শুভজিৎ দে

দেখে মনে হয় ইতিহাস প্রতি ১০০ বছর পরে নিজেকে পুনরাবৃত্তি করছে , এটি কি কেবল কাকতালীয় ঘটনা? একদমই না । তবে কি ভাবে এটা সম্ভব তার উত্তর দিতে গেলে বলতেই হয় - 

"চারপাশের সমস্ত কিছু নিয়ে গড়ে উঠেছে পরিবেশ;
দূষণের কারণে ধীরে-ধীরে হচ্ছে প্রকৃতি শেষ,
পরিবেশের অবদানে গড়ে উঠেছে জাগতিক পরিস্থিতি,
মানব সভ্যতার ভুলের কারণে প্রকৃতির হচ্ছে দুর্গতি!"




বুবোনিক প্লেগ


পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্যে (বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য)প্রথম প্লেগ দেখা যায় যা সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান এর নামানুসারে জাস্টিনিয়ানের প্লেগ নামকরণ করা হয়। সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ান প্লেগে আক্রান্ত হলেও ব্যাপক চিকিৎসায় তিনি বেঁচে যান। উক্ত মহামারীতে প্রায় আড়াইকোটি(৬ষ্ঠ শতাব্দীর মহামারী) থেকে পাঁচ কোটি লোক প্রাণ হারায়। ঐতিহাসিক প্রকোপিয়াস তার হিস্ট্রি অব দ্যা ওয়ারস গ্রন্থের ২য় ভলিউমে প্লেগের সাথে তার নিজের লড়াই ও উদীয়মান সাম্রাজ্যের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে লিখেছিলেন। ৫৪২ খ্রিষ্টাব্দের বসন্তকালে, প্লেগ কনস্টান্টিনোপলে পৌঁছে বন্দর থেকে বন্দরে ও ভূমধ্যসাগরের চারিদিকে ছড়াতে থাকে। পরবর্তীতে পূর্বদিকে এশিয়া মাইনর পশ্চিমদিকে গ্রিস ও ইতালিপর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। সম্রাট জাস্টিনিয়ানের প্রচেষ্টায় বিলাসবহুল পণ্যদ্রব্য আমদানি-রপ্তানি হওয়ায় পণ্যদ্রব্য স্থানান্তরের কারণে দেশের অভ্যন্তরে প্লেগ ছড়িয়ে যায় এবং তার রাজধানী বিউবনিক প্লেগের প্রধান রপ্তানিকারকে পরিণত হয়। প্রিকোপিয়াস সিক্রেট হিস্ট্রি গ্রন্থে জাস্টিনিয়ানকে পিশাচ সম্রাট হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন যে, জাস্টিনিয়ান হয় নিজে প্লেগের স্রষ্টা ছিলেন নতুবা তার পাপকর্মের জন্য শাস্তি পাচ্ছিলেন।

কলেরা মহামারী



183২ সালের কলেরা মহামারী ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং দুটি মহাদেশের মধ্যে ভর প্যানিক সৃষ্টি করে। অদ্ভুতভাবে, মহামারী নিউ ইয়র্ক সিটি আঘাত যখন এটি হিসাবে অনেক হিসাবে উত্সাহিত 100,000 মানুষ, প্রায় অর্ধেক শহরের জনসংখ্যা, গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে যেতে। এই রোগের আগমন ব্যাপক প্ররোচনামূলক অভিবাসীর অনুভূতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কারণ এটি আমেরিকাতে নতুন আগমনের দ্বারা দরিদ্র দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৃদ্ধি পায়। মহাদেশ ও দেশ জুড়ে রোগের চলাচলের ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারি করা হয়েছিল, তবে তা কীভাবে প্রেরণ করা হয়েছিল তা বোঝা যায় না। এবং মানুষ ভয়ঙ্কর উপসর্গ দ্বারা ভীতিপ্রদভাবে ভয় পেয়েছিল যা অনুভব করলো যে, তাড়াতাড়ি শিকারকে কষ্ট দিয়েছে।

হঠাৎ অসুস্থ হয়ে উঠলে কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে, ত্বকটি ভয়ানক নীল রঙের ত্বকে পরিণত হয়, ঘন ঘন নিঃশব্দ হয়ে যায় এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যায়। এটি 19 শতকের শেষের দিকে না থাকায় বিজ্ঞানীদের নিশ্চিত ছিল যে কলেরা জলের মধ্যে বহন করা ব্যারিলাস দ্বারা সৃষ্ট হয়। 

স্প্যানিশ ফ্লু বা সোলজার অব নেপলস


১৯১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন অন্তিমদশায়। সেসময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ডেভিড লয়েড জর্জ। মিত্রশক্তির সাফল্যে তিনি তখন বেশ উল্লসিত। দেশে অবস্থানরত সৈন্য এবং যুদ্ধোপকরণ তৈরির নারী কর্মীদের সাময়িক ছুটি দিয়ে তাদের সাথে নিয়ে ম্যানচেস্টার সফরে যান লয়েড জর্জ। কিন্তু সন্ধ্যায় হঠাৎ করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর জ্বর ও গলাব্যথা শুরু হয়। ধীরে ধীরে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর লয়েড জর্জকে টানা ১০ দিন ম্যানচেস্টারের টাউন হলে শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়েছিল। ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান থেকে শুরু করে অধিকাংশ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের ধারণা ছিল তার অসুস্থতার পেছনে জার্মানির হাত রয়েছে। তাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসকরা সেই দাবি নাকচ করে দেন। পরবর্তীতে জানা যায় তিনি স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন। স্প্যানিশ ফ্লুর নাম তখনও নির্ধারণ করা হয়নি। এই নামকরণ হয়েছিল অনেক পরে। তবে সে যাত্রায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ভাগ্যবান ছিলেন। এবং কোনোক্রমে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটেনের প্রায় আড়াই লাখ মানুষ তার মতো ভাগ্যবান ছিলেন না। 

এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ছিল কল্পনাতীত। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, সেই সময় পুরো বিশ্বে স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষ, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মৃতের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। 
শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল, স্প্যানিশ ফ্লু সম্ভবত কোনো ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হচ্ছে। স্পেন থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক সংবাদমাধ্যমই এমন খবর প্রকাশ করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, এই তথ্য ভুল। স্প্যানিশ ফ্লুর জন্য দায়ী ছিল এক নতুন ধরনের ভাইরাস। পরবর্তীতে গবেষণার মাধ্যমে সনাক্ত করা হয়।

১৯১৭ সালের ৬ এপ্রিল, মিত্রপক্ষে যোগ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ছিল তুলনামূলক ছোট। কিন্তু যুদ্ধে যোগ দেয়ার কয়েক মাসের মাথায় তারা বিশাল এক সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলে, যার মধ্যে থেকে প্রায় দুই মিলিয়ন সেনা ইউরোপে যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়।

বিশাল সৈন্যবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা তখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল না। কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদেই তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন ক্যাম্প তৈরি করে। এর মধ্যে একটি ছিল কানসাসের ফোর্ট রাইলি। সেখানে সেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নতুন করে ক্যাম্প ফান্সটন তৈরি করা হয়।

ক্যাম্প ফান্সটনে মোট ৫০ হাজার সেনার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে ১৯১৮ সালের মার্চের শুরুতে প্রথমে এক সৈন্য জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এর কয়েক ঘণ্টার মাথায় আরো শতাধিক সেনা একই কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে এই সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। মূলত এটি ছিল স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তি, যার মূল কারণ ছিল পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থার অভাব। একই জায়গায় বহু সংখ্যক সেনা থাকার কারণে সেখানে খুব সহজেই রোগের বিস্তার ঘটেছিল। পরবর্তীতে এপ্রিলে যখন মার্কিন সেনারা নিজ দেশ ছেড়ে ইউরোপের যুদ্ধের ময়দানে আসে, তখন তারা সাথে করে সেই ভাইরাসও নিয়ে আসে। এরপর তাদের থেকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। স্প্যানিশ ফ্লুর হাত থেকে পৃথিবীর কোনো অংশই ছাড় পায়নি। এশিয়া, আফ্রিকাসহ প্রশান্ত মহাসাগরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল।

স্প্যানিশ ফ্লুর ৩০ বছর আগে ইউরোপে রাশিয়ান ফ্লুর সংক্রমণ হয়েছিল, যার উৎপত্তিস্থল ছিল উজবেকিস্তানের বুখারা। উজবেকিস্তান সেই সময় রাশিয়ার অংশ ছিল। যে কারণে সেই ভাইরাসের নাম হয়েছিল রাশিয়ান ফ্লু। কিন্তু স্প্যানিশ ফ্লুর নামকরণ হয়েছিল অন্যায়ভাবে। কারণ এই ভাইরাসের উৎপত্তি স্পেনে হয়নি। আবার তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কোনো পক্ষের হয়ে যুদ্ধেও জড়ায়নি। কিন্তু তাদের এই নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণেই ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়ের সাথে তাদের নাম জুড়ে গেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া দেশগুলোর সরকার তাদের সংবাদমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেনও ছিল। সরকারের অনুমতি ছাড়া সেসব দেশের সংবাদমাধ্যম সংবেদনশীল কোনো খবর প্রকাশ করতে পারতো না। কিন্তু স্পেন যেহেতু নিরপেক্ষ ভূমিকায় ছিল তাই তাদের সংবাদমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

যার ফলে রাজা ত্রয়োদশ আলফানসো এবং তার মন্ত্রীসভার বেশ কয়েকজন সদস্য যখন বিশেষ সেই ভাইরাসে সংক্রমিত হন, তখন স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম সেই খবর বেশ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমের কারণে তখন ইউরোপে প্রথমবারের মতো এই ভাইরাসের কথা শোনা যায়। যদিও এর আগেই ইউরোপে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ব্রিটেন, ফ্রান্স কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার চায়নি তাদের জনগণ নিজ দেশে এমন রোগের কথা জানতে পারুক। ফলে নিজেদের যুদ্ধের যৌক্তিকতাকে ধরে রাখার জন্য তারা এই খবর গোপন করেছিল। এরপর স্পেনের সংবাদপত্র যখন তাদের রাজার অসুস্থ হওয়ার খবর প্রকাশ করে, তখন ব্রিটেনের ও ফ্রান্সের নেতারা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল হিসেবে স্পেনের নাম প্রচার করে। যার ফলে তখন ভাইরাসটির হয়ে যায় 'স্প্যানিশ ফ্লু' পরবর্তীতে স্প্যানিশরা ভাইরাসটিকে 'সোলজার অব নেপলস' নাম দেয়।


করোনা মহামারী


আজ, চীন সহ সারা বিশ্বজুড়ে একটি বড় মহামারীর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, চীন পুরো পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। চীন হওয়া এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসেটি ইতিমধ্যে সারা বিশ্ব ছড়িয়ে পড়েছে। দুনিয়াজুড়ে মৃতের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওমিটারস ডট ইনফো’র হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ সময় ১৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯৬। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ৮৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসা গ্রহণের পর সুস্থ হয়ে উঠেছে ৭৫ হাজার ৯২২ জন।

চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসের কারণে থমকে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ঘরের ভেতরেই থাকতে হচ্ছে বিশ্বের প্রায় ১৪৫টি দেশের মানুষকে। সবাই এক রকম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। ইতালিতে এখন ঘরে ঘরে কারাগারের মতো অবস্থা। সরকারি নির্দেশে দেশটির সবাই এখন স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি। অবরুদ্ধ ইতালিতে বন্দিজীবনে অলস সময় পার করছেন সেখানকার বাসিন্দারা। জীবন যেন থমকে গেছে। সুস্থ থাকলেও ঘরের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

উৎপত্তিস্থল চীনে সরকারি হিসাবেই এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০ হাজার ৮২৪। এর মধ্যে তিন হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসা গ্রহণের পর সুস্থ হয়ে উঠেছে ৬৬ হাজার ৯১১ জন। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় ওপরের সারিতে থাকা অন্য দেশগুলোর মধ্যে ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের নাম উল্লেখযোগ্য।



** শতবর্ষ আসে, শতবর্ষ যায়, আধুনিকতার দৌড়ে সভ্যতা এগালেও, মানবতা থমকে দাঁড়িয়ে যায় । পরের শতবর্ষ সুস্থ ভাবে বাঁচতে বৃক্ষরোপণ করুণ, গাছ কাটা বন্ধ না হলে আমাদের এর থেকেও অনেক ভয়ানক পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে