ধর্মতলা আর এসপ্ল্যানেড কিন্তু এক জায়গা নয় - শুভজিৎ দে

এসপ্ল্যানেড হল মধ্য কলকাতার একটি অঞ্চল। এটি আক্ষরিক অর্থে "এসপ্ল্যানেড" নয়; কারণ এই অঞ্চলটি কোনো জলাশয়ের ধারে অবস্থিত নয়। যদিও হুগলি নদী এই অঞ্চলের কিছু দূর দিয়েই প্রবাহিত হয়। এসপ্ল্যানেড শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এটি শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। কলকাতার ময়দান অঞ্চলটি অতীতে ছিল জঙ্গল এলাকা। এই জঙ্গলের উত্তর অংশটিকে এসপ্ল্যানেড নাম দেওয়া হয়। পুরনো কলকাতার ধর্মতলা (অধুনা লেনিন সরণি) থেকে হুগলি নদীর তীরবর্তী চাঁদপাল ঘাট পর্যন্ত এসপ্ল্যানেড বিস্তৃত ছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় এই অঞ্চলটি ব্রিটিশদের প্রমোদ ভ্রমণের জন্য প্রিয় রাস্তায় পরিণত হয়। ১৭৮০ সালে সোফিয়া গোল্ডবর্ন লিখেছেন, কলকাতার পাঁচটি প্রধান রাস্তা এই অঞ্চলটি ঘিরে ছিল। পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে ১৭৫৮ সালে এসপ্ল্যানেডের কাছেই ফোর্ট উইলিয়ামদুর্গের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এরপর কলকাতায় ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর বসতি ছোটো অঞ্চল ছেড়ে ধীরে ধীরে ময়দানের আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে, এসপ্লানেড ও ধর্মতলা এক জায়গা নয়।

 Esplanade in Calcutta in India, 1800

কলকাতা তখন বেশ জমজমাট । বাণিজ্যের তাগিদে বাইরে থেকেও লোকজন আসছে । কোম্পানির খাসতালুক । লোকজনের বসতি করতে শুরু করে দিয়েছে । ফাঁকা ধূ ধূ প্রান্তরগুলি তখন পাড়ায় পরিণত হচ্ছে । ১৮২২ সালে ইংরেজরা একটা জন সমীক্ষা করেন । দায়িত্বে হলওয়েল । কিন্তু লোক সংখ্যা ও লোক গণণার মধ্যে ব্যাপক ফারাক সেই সমীক্ষায়। ইংরেজ মুখপত্র ‘John Bull’-এ লেখা হচ্ছে সেই পার্থক্যের কথা—
‘the division between Dhurrumtolla and Bow bazar has a denser population; it comprises most thickly inhabited European part of Calcutta as well as a great number of country born Christians, who reside in the town with their families.’

হ্যাঁ, সে সময়ই জন্ম হয়ে গিয়েছে ধর্মতলার। সম্ভবত রাইটার্স বিল্ডিংস, ফোর্ট উইলিয়াম কাছে বলেই সাহেবদের ডেরা তখন ধর্মতলার পাড়া । আজকের মত সে ধর্মতলা অগোছালো নয় । সাজানো গোছানো । ১৮২৮ সালে ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকা লিখছে—“Dhuramtolla in 1798 was described as an ‘open and airy road’. It was ‘well- raised cause-way’ above fields and lined with trees.”

ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার চৌরঙ্গি ফটক, গোবিন্দপুর, কলকাতা, c১৮৮০

ইংরেজদের বাস যেখানে, সেই জায়গার বাংলা নাম! শুধু তাই নয়, সে জায়গার নাম আবার ধর্মতলা? ধর্মতলা নামটা কেন, তা নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে । প্রথম মতটি লঙ সাহেবের । তাঁর মতে, এই নামকরণ একটি মসজিদকে কেন্দ্র করে—এখন যেখানে টিপু সুলতান মসজিদ, তার পাশেই ছিল একটি আস্তাবল। সেই আস্তাবলের জমিতেই এক সময় ছিল আরও একটি মসজিদ। কলকাতার সর্বপ্রথম কারবালার জনসমাবেশ হত এই মসজিদে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি দিয়েছিলেন হর্নেল সাহেব। তাঁর মতে,জানবাজারে বৌদ্ধরা থাকতে শুরু করেন। আর ‘ধর্মং শরণম গচ্ছামি’ থেকে এই জায়গার নাম হয় ধর্মতলা।

তবে এসব ব্যাখ্যার বাইরের ব্যাখ্যাটি হল—ধর্মতলার নামকরণ হয় ধর্ম ঠাকুরের নামে। ধর্ম ঠাকুর হলেন গ্রামবাংলার দেবতা। সুন্দরবনে যেমন বাঁকা রায় বা কালু রায়কে ধর্ম ঠাকুর হিসেবে পুজো করা হয়, তেমনই রাঢ় বঙ্গের নানা জায়গায় ধর্ম ঠাকুরের পুজোর প্রচলন আজও আছে। কলকাতা যখন গড়ে উঠছে, তখন নিম্নবর্গীয় মানুষরা জানবাজার অঞ্চলে থাকতে শুরু করেন। একাধিক ধর্মঠাকুরের মন্দির তাঁরা নির্মাণ করেন এই অঞ্চলে। সেই থেকেই এই জায়গার নাম হয় ধর্মতলা। এ প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ লিখে গিয়েছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের ঘাটাল, আরামবাগ অঞ্চল থেকে আগত মৎস্যব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকে ধর্ম্মতলা অঞ্চলে প্রথমে যখন এসে বসতি স্থাপন করেন, তখন থেকে ধর্ম্মঠাকুরের পূজার প্রচলন করেন এই অঞ্চলে।

কলকাতার মধ্যে তাদের প্রভাবও ছিল যথেষ্ট…মহাসমারোহে তাঁরা ধর্ম্মঠাকুরের উৎসব করতেন, তার গাজন হ’ত, মেলা বসত…ধর্ম্মতলা নাম এখানকার ধর্ম্মঠাকুরের এই আঞ্চলিক প্রতিপত্তি ও উৎসব থেকেই হয়েছে । জেলিয়াপাড়ার প্রাচীন মত্স্যব্যবসায়ীরা কলকাতার ধর্ম্মতলা অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রচনা করেছেন । অন্য কেউ করেননি । ধর্ম্মতলার সংলগ্ন আরও অনেক স্থানে ধর্ম্মঠাকুরের পূজা হ’ত বলে অনুমান করা যায় জানবাজারে তো হ’তই, ডোমটুলি, হাড়িপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলেও হ’ত।…ডোমপণ্ডিতরা যে ধর্ম্মঠাকুরের পূজারী তা সকলেই জানেন।…এক সময় নাথ পণ্ডিতরাও কলকাতায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ ছিলেন। নাথযোগীরাও ধর্ম্মঠাকুরের পূজা করতেন।’

১৮৪১ সালে প্রকাশিত ‘বেঙ্গল ও আগ্রা অ্যানুয়াল গেজেটিয়ার’-এ স্পষ্ট করা আছে ধর্মঠাকুরের মন্দিরের ঠিকানা—‘Dhammoh Thakur: 51, Janbazar Street.’ আবার হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ৪৫ নং জানবাজার স্ট্রিটে ধর্মঠাকুরের মন্দির দর্শন করেছিলেন । প্রাণতোষ ঘটক লিখছেন, ‘ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পেছনে বাঁকা রায় স্ট্রীট নামে একটি রাস্তা ধর্ম্মতলায় এসে পড়েছে। এই পল্লীতে বাঁকা রায়ের একটি মন্দিরও আছে । এই বাঁকা রায় কোনও ব্যক্তিবিশেষ নন, তিনি ধর্ম্মঠাকুর ।’

এই জায়গা কে অনেকেই একটু কায়দা করে বলে থাকেন ‘স্প্ল্যানেড’। কিন্তু ‘স্প্ল্যানেড’ শব্দের কোনও অর্থ নেই। এসপ্ল্যানেড বা গড়ের মাঠ শব্দের অর্থ আছে— দুর্গ ও শহরের মধ্যবর্তী সমতল স্থান। একেবারেই তো তাই। একদিকে দুর্গ বা ফোর্ট উইলিয়ম আর অন্যদিকে বসতি। তার মাঝের অংশ তো এসপ্ল্যানেড। অধ্যাপক বিমান সমাদ্দার এসপ্ল্যানেড সম্পর্কে আমাদের গল্প (তথ্য) বলতে গিয়ে বলেন " দূর্গ বা ফোর্টের সামনে এমন খোলা জায়গা রাখা জরুরী, এক উন্মুক্ত স্থান থাকার জন্য ফোর্টের রক্ষীবাহিনীর সুবিধা হত, কোনো বিপক্ষ শক্তি দূর্গ আক্রমণ করেছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে, আর যদিও বা কেউ আক্রমণ করে, তার জন্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবার সময় পাবার জন্য এমন পরিকল্পনা করা হয়েছে সে সময়ে।"

( Photograph of Lord Hardinge's statue and the Ochterlony Monument, from 'Views of Calcutta and Barrackpore' taken in the 1860s by Samuel Bourne. From: British Library )

এই এসপ্লানেডে সম্পর্কে একটা মজার তথ্য পাঠককে জানাই। যখন ধর্ম নিয়ে এত কথা হল, তখন এই এসপ্লানেড অঞ্চলে একটি ধার্মিক কাজের উদাহরণ দেওয়া যাক। মিউজিয়ামের ঠিক উল্টোদিকে, বর্তমানে কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে ছিল একটি বড় পুকুর। অনেকের মতে, এখানে অনেক কাল আগে ছিল একটি ছোট ডোবা। কিন্তু ১৮০০ সালের আশে পাশে নিজ খরচায় পুকুর কাটিয়ে দেন ইংরেজদের ব্যাঙ্কার মনোহর দাস।

এই পুকুর খননের পিছনে মনোহর দাসের উদ্দেশ্য ছিল জীব সেবা । গরু বা অন্য কোনও পশুর জল খাওয়ার জন্য এই পুকুর তিনি কাটিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, সংলগ্ন একশ বিঘা জমি তিনি কেনেন গো চারণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। আর ধার্মিক লোক ছিলেন বলে পুকুরের চারপাশে চারটি মন্দির তিনি তৈরি করেন। শিব, সূর্য, বিষ্ণু ও দেবীর মন্দির। এই পুকুর এখনও আছে। তবে জল অনেক কমে গিয়েছে, পুকুর অনেকটাই এখন ছোট। মন্দিরের অস্তিত্বও আছে। বিগ্রহ তাতে আর নেই। যাই হোক, ধর্মতলা শুধু যে ধর্ম ঠাকুরের পুণ্যতীর্থ তা কিন্তু নয়, মনোহর দাসের মত ধার্মিক লোকেদেরও কর্মতীর্থ।

তথ্যসূত্র

Wikipedia

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে