বঙ্গ সংস্কৃতি : পটচিত্র - শুভজিৎ দে

গ্রাম বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের অন্যতম আকর্ষণ পটচিত্র। পটচিত্রের শুরু কবে তার সঠিক সময়কাল জানা সম্ভব হয়নি। অনুমান করা হয় পটচিত্রের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। পট এর আভিধানিক অথর্ -বস্ত্র, যা সংস্কৃত ‘পট্ট’ শব্দ থেকে এসেছে। লম্বা কাপড়ে দীর্ঘ রেখা টেনে ছবি আঁকাই হচ্ছে পটচিত্র। পটচিত্র আঁকার কাজে ব্যবহৃত হত দেশজ রঙ এবং মোটা কাপড়। তবে, কাপড়ে পটচিত্র আঁকার প্রচলন কমে যায় কাগজ আবিষ্কারের পর থেকেই। পট চিত্রশিল্পীদের ডাকা হয় ‘পটুয়া’ নামে। তাঁরা যে শুধু চিত্রশিল্পীই তা নয়, তাঁরা চিত্র প্রদর্শনীর সময় সুরে সুরে গানে গানে কাহিনী বিবরণ করেন । পটচিত্রের সময় যে গান গাওয়া হয় তা ‘পটের গান’ নামে পরিচিত। ‘পটুয়া’রা সাধারণত মাপকাঠি কিংবা মডেল সামনে বসিয়ে নিয়ম-রীতি মেনে ছবি আঁকেন না। দীর্ঘ রেখা টেনে কাহিনী চিত্রায়িত করেন নিজেদের মতো করে। শিল্প-সমোঝদারদের কাছে গুরুত্ব পায়নি এই পটচিত্র। পটচিত্রের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য কিংবা স্বকীয়তা রয়েছে। রেখা টানার সময় সেখানে কোনো অনুভূতি প্রকাশের প্রয়োজন মনে করেন না, বিভিন্ন রকমের অবয়ব এঁকে গল্প সাজান ধারাবাহিকভাবে।পটচিত্রগুলো সুনিপুণ হয় না। কারণ, সাধারণ কয়েক ধাপে আঁকা হয়। প্রথমে চিত্রকর অবয়ব আঁকেন, তারপর মহিলারা রং ঢালাই করেন। এভাবে একসাথে প্রায় দেড়শো-দুইশো পট এঁকে ফেলেন তাঁরা। যে কারণে খুব সূক্ষ্মতম ছবি আঁকার ক্ষেত্রে পটুয়ারা অনভ্যস্ত। তাঁরা তাঁদের ছবিতে বিভিন্ন গল্প সাজানোকে প্রধান কাজ মনে করেন। পটচিত্র অঙ্কনের জন্যে লোকজ কাহিনী, পৌরাণিক কাহিনী, কিংবা দীর্ঘ কোনো গল্পের প্রয়োজন হয়। পটুয়াদের রয়েছে সীমাহীন ধৈর্যশক্তি, তাঁরা বিভিন্ন অঞ্চলে, হাতে প্যাঁচানো পটচিত্র একটা একটা করে খুলে কাহিনী বর্ণনা করেন সুরে সুরে। সবচেয়ে প্রচলিত দুইটি পটচিত্র হচ্ছে- কালিঘাট পটচিত্র ও গাজীর পটচিত্র। প্রথম দিকে পটচিত্র ছিল ধর্মীয় জ্ঞানসমৃদ্ধ। পটুয়ারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে পটচিত্র দেখিয়ে গল্প বর্ণনা করার সাথে সাথে নীতিকথাও বর্ণনা করতেন। ধীরে ধীরে পটচিত্রের প্লাটফর্মে পরিবর্তন আসে। লোকবিশ্বাস-রূপকথা-কুসংস্কার মিশে যায় পটুয়াদের মাঝে। যার কারণে, নারীচিত্র উপস্থাপন হতো অশ্লীল ভঙ্গীতে। কালিঘাটের পটচিত্রে এর কিছু প্রমাণ মিলে জায়গায় জায়গায়। আনন্দের খোরাক জোগাতে বিভিন্ন রাজা-রাণীর কাহিনী, দস্যু কাহিনী, লৌকিক গাঁথা পটুয়ারা দেখিয়ে বেড়াতো এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে। মূলত, এটা ছিল মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় পটচিত্র ছিল গাজীর পট। এখানে বিধৃত হয়েছে বিজয় গাথা। গাজীর পট ছিল ইসলামভিত্তিক পটচিত্র, তবে কোনো কোনো জায়গায় গাজীকে বাঘের দেবতা রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। ধীরে ধীরে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং উচ্চমানের শিল্পকলায় পটচিত্র পিছনে পরে যায়। বিনোদনের বিভিন্ন আকর্ষনীয় মাধ্যমের কারণে মানুষ ভুলে যেতে থাকে পটচিত্রের কথা। বাংলার লোকসংস্কৃতির অন্যতম এই পটচিত্র বর্তমানে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে। এখনো কিছু এলাকায়, পটুয়াদের বংশধর, পারিবারিক ঐতিহ্য চর্চায় এঁকে চলেছেন পটচিত্র। হাজার বছরের দেশীয় ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায় সেদিকে নজর দিতে হবে আমাদের শিল্পীসমাজকেই। বেঁচে থাকুক পটশিল্প- শিল্পীর তুলির আঁচরে, মননে, গল্প ও গানে। পটচিত্র পটে অঙ্কিত বিভিন্ন চিত্র। সংস্কৃত পট্ট (কাপড়) শব্দ থেকে পট শব্দের উৎপত্তি, আর এই পটে অঙ্কিত চিত্রই হচ্ছে পটচিত্র। প্রাচীন বাংলায় যখন কোন দরবারি শিল্পের ধারা গড়ে ওঠেনি তখন পটচিত্রই ছিল বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক।

চিত্রঋণ - এবেলা

পট প্রধানত দু প্রকার দীর্ঘ জড়ানো পট ও ক্ষুদ্রাকার চৌকা পট। জড়ানো পট ১৫-৩০ ফুট লম্বা ও ২-৩ ফুট চওড়া হয়। আর চৌকা পট হয় ছোট আকারের। কাপড়ের উপর কাদা, গোবর ও আঠার প্রলেপ দিয়ে প্রথমে জমিন তৈরি করা হয়। তারপর সেই জমিনে পটুয়ারা তুলি দিয়ে বিভিন্ন চিত্র অঙ্কন করেন। পটে নানা ধরনের দেশজ রং ব্যবহূত হয়। ইঁটের গুঁড়া, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদিও রঙের কাজে ব্যবহার করা হয়। পটটিকে সাধারণত কয়েকটি অংশে ভাগ করে তার উপর লাল, নীল, হলুদ, গোলাপি, বাদামি, সাদা ও কালো রং লাগিয়ে ছবি আঁকা হয়। তুলি হিসেবে ব্যবহূত হয় কঞ্চির ডগায় পশুর লোম বা পাখির পালক। পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) ও বাংলাদেশে আজও একটি বিশেষ চিত্রকর সম্প্রদায় এক আখ্যানধর্মী লোকচিত্রকলার পেশায় নিয়োজিত।এ শিল্পকলার আদি উৎপত্তি সম্পর্কে যেমন কিছু জানা যায় নাতেমনি এ শিল্পকর্মে নিয়োজত চিত্রকর সম্প্রদায়ের আদি উৎপত্তিও জল্পনা-কল্পনার বিষয়।

শিল্পী প্রবীর চিত্রকর 

মধ্যযুগের হিন্দু জনসমাজ তাদের স্বকীয় যাথার্থ্যবোধে পেশাগত সোপানিক ভিত্তিতে সমাজে বর্ণপ্রথা গড়ে তোলে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে বিশ্বরূপকার বিশ্বকর্মার নয় ছেলে সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ঐ আখ্যান অনুযায়ী, নিচুজাতের এক রমণীর সঙ্গে বিশ্বকর্মার মিলনের ফলে ঐ নয় সন্তানের জন্ম হয়। ঐ নয় সন্তান তথা নবসায়কের নিয়তি নির্ধারিত হয় তাদেরকে গতর খাটিয়ে বেঁচে থাকতে হবে - এভাবে। পটচিত্রকরকে ঐ নয় সন্তানের কনিষ্ঠ সন্তান গণ্য করা হয়। আট সন্তান পেশাগত বা অন্যান্য উপায়ে সামাজিক পর্যায়ে তাদের অবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হলেও, নবম চিত্রকর সন্তানটি তাতে ব্যর্থ হওয়ায় তার জন্মকালের ললাটলিপির বোঝাই তাকে বয়ে চলতে হয়্। চিত্রকরদের এ জনসমাজ সামাজিক পর্যায়ে তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য একযোগে ইসলাম গ্রহণ করে। তবে যেহেতু তারপরেও তাদের মধ্যে প্রতিমাপূজার রীতি থেকে যায় সে কারণে তারা মুসলিম জনসমাজের মূলধারায় সামাজিক পর্যায়ে গৃহীত বা স্বীকৃত হয় নি। আর তাই এ জনসমাজের লোকেরা তাদের দ্বৈত পরিচয় দিয়ে থাকে। নিজ সমাজের মধ্যে তারা তাদের মুসলিম নামে পরিচিত আবার তাদের হিন্দু গ্রাহকদের কাছে তাদের পরিচয় দেওয়া হয় হিন্দু নামেই। তবে তাদের নামের সাথে সাধারণ নাম: চিত্রকর -এ শব্দটি দেখেই তাদের পেশা ধরা যায়।

পটচিত্র বিক্রয়যোগ্য পণ্য নয়। পটচিত্রকর্ম বংশানুক্রমিক পেশা রক্ষার উপায়। এ শিল্পশৈলীর উত্তরাধিকার এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে বর্তায়। পটুয়া, পটিদার ও পট- এ সব নামে একজন চিত্রকর সাধারণত পরিচিত। চিত্রকর একাধারে কবি, গায়ক ও চিত্রশিল্পী। চিত্রকর হিন্দু অতিকথার আখ্যান কাহিনীকে ছড়ার আকার দেয়। আর তাতে একটা নীতি শিক্ষার বিষয়ও থাকে। স্ক্রোল পেন্টিং বা জড়ানো পটে ধারাবাহিক কয়েকটি কাঠামো বা ফ্রেমে আখ্যানকাহিনীর ধারাচিত্রগুলি আঁকে পটচিত্রকর। গ্রাহকের কাছে সে তার জড়ানো পটের ফ্রেমগুলি একের পর এক খুলে ধরে বর্ণনা করে যেতে থাকে। আর তার মাঝে যে নীতি শিক্ষার বিষয় তুলে ধরা হয় তাতে জীবনের নানা পাপ ও পুণ্য সম্পর্কে শ্রোতারা সজাগ হয়ে ওঠে।

পটচিত্রের পরিকল্পনা ও শৈলীতে শিল্পকলার কোন উদ্ভাবনী প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার আকুতি পরিদৃষ্ট হয় না। বংশানুক্রমে হস্তান্তরিত ও পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া শৈলীর প্রশিক্ষণে ধরাবাঁধা কিছু ধারাবিন্যাস, রেখা, রং এবং ভাবভঙ্গিমার গতানুগতিক উত্তরাধিকার এ পটচিত্রকলা। এগুলির সবই শেখানো হয় পরের প্রজন্মকে। শৈলীগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে শৈলী আমরা পটচিত্রে লক্ষ করি, তাতে এক অনন্য আকৃতিগত সারল্য ও রঙের অপূর্ব সুসঙ্গতি নজরে পড়ে। পটচিত্র বাংলার লোকশিল্পকলার সকল ঐতিহ্যিক উৎকর্ষে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এ শিল্পকলা সাংস্কৃতিক সমজাতীয়তায় ও মূর্তির সাথে নিবিড় সম্পর্কিত এক জনগোষ্ঠীর উদ্দেশে নিবেদিত। পটচিত্র সাধারণত কাগজ বা মাড়যুক্ত কাপড়ে অাঁকা হয়। সম্মূখমুখী প্রতিকৃতির তিন চতুর্থাংশ পটচিত্রে দেখা যায়। এতে হাতের তালু থাকে মুষ্টিবদ্ধ। পটচিত্রের আঁকা তথা ড্রয়িং ধর্মীয় প্রকৃতির হোক (hieratic) কিংবা নিছক রেখার নকশা (diagrammatic) হোক তাতে স্থানন্যাসে গভীরতার (spatial depth) অভাব লক্ষ করা যায়। পটচিত্রে ঢালাও (flat), প্রাণবন্ত রং ব্যবহার করা হয়। চিত্রে দেহাবয়বের ভাবভঙ্গিতে ক্রিয়ার প্রকাশ ঘটলেও মুখে কোন অভিব্যক্তি নেই। সমোন্নতি রেখার চারধারে কলোরেখায় আকৃতির ভেতরে রৈখিক বিভাজনগুলি লক্ষ্যণীয়। প্রথম প্রলেপের রঙে রয়েছে বিশুদ্ধ রং ও উদ্ভিদ রঞ্জক। কালো রঙের জন্য ঝুলের কালি ব্যবহার করা হয়। জড়ানো পটচিত্রে (scroll painting) বিশটিরও বেশি ফ্রেম বা কাঠামো থাকে। এ ছাড়াও থাকে, আড় লতাই বা আয়তাকার জড়ানো পট (oblong scroll) যাতে বিশেরও বেশি ফ্রেম থাকে। যমপট বা জাদুপট ও চক্ষুষ্মান পট এগুলির সাথে ধর্মীয় নিদানতত্ত্ব (eschatology) সম্পর্কিত। এগুলি সাম্প্রতিক কোন ঘটনায় শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য আঁকা হয়। হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত নানা আখ্যানকাহিনী চিত্রিত করার জন্য চিত্রকরেরা লোকসাহিত্য উপাদানের সাহায্য নিয়ে থাকে। এসব ছবিতে মানব ও দেব প্রতিকৃতির সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়, তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলির তফাৎ অবশ্য লক্ষ করা যায় তাদের মাথায় পরা মুকুট ও অন্যান্য দেবমূর্তি সম্পর্কিত বিশেষ চিহ্নগুলিতে। চিত্র বর্ণনায় বাস্তব ও কল্পনার উপান্তিক সীমানা মিলেমিশে একাকার হতে দেখা যায়। এধরনের লোকপ্রিয় অতিকথামূলক ধর্মীয় মূলভাবগুলির উদাহরণে মহিষাসূরমর্দিনী, কমলে কামিনী, বেহুলা-লখিন্দর, মনসা-চাঁদ সওদাগর, কৃষ্ণ-রাধা, চৈতন্যলীলা এ সবের উল্লেখ করা যায়। মরং বুরু, মরা-হাজা, পিচলু বুড়ি ইত্যাদির কাহিনী সাঁওতাঁল সম্প্রদায়ের জন্য আঁকা হয়ে থাকে। আর মিশ্রশ্রেণীর গ্রাহকদের জন্য পীরপট আঁকা হয়। এতে পীর যে সব অলৌকিক ঘটনা সম্ভব করেন তা অাঁকা হয়। রাশিচক্র দেখিয়ে রাশিপট আঁকার বিষয়টিও জনপ্রিয়। যম, যাদু ও চক্ষুদানপটের মতো রাশিপট যাদুটোনা ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। চৌকা পটের মধ্যে চক্ষুদান পট কৌতূহলোদ্দীপক। পটুয়ারা মৃত ব্যক্তির চক্ষুবিহীন কাল্পনিক ছবি এঁকে তার স্বজনদের নিকট গিয়ে এই বলে পারিশ্রমিক দাবি করত যে, চোখ আঁকা না হলে তারা স্বর্গের পথ দেখতে পাবে না। চৌকা পটের মধ্যে কালীঘাটের পট বিখ্যাত। ১´ × ৮´ মাপের কাগজে দেবদেবী, মানুষ, ব্যঙ্গ প্রভৃতি বিষয় অবলম্বনে এই পট অঙ্কিত হতো। আঠারো-উনিশ শতকের কলকাতা ছিল এর লালন ক্ষেত্র।



পটের বিষয়বস্ত্ত হয় সাধারণত ধর্মীয়, সামাজিক ও কাল্পনিক। পটুয়াদের তুলিতে মানুষের ভাবলোক ও আধ্যাত্মিক জীবন সহজ-সরলভাবে প্রতিফলিত হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আট শতক থেকে বুদ্ধদেবের জীবনী-সংক্রান্ত জাতকের গল্পসম্বলিত মস্করী নামক পট প্রদর্শন করতেন। পরবর্তী সময়ে হিন্দুধর্ম ও  পুরাণ হয় পটের প্রধান বিষয়। হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবী, যেমন: দুর্গা, কালী, মনসা, অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী, যম, চন্ডী, দশ অবতার প্রভৃতি; পৌরাণিক কাহিনী, যেমন: রামলীলা, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি, এমনকি কৈলাস, বৃন্দাবন, অযোধ্যা ইত্যাদি পবিত্র স্থানসমূহও এতে মূর্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া জাদু, গাজী এবং হিতোপদেশমূলক চিত্রপটও অঙ্কিত হতে দেখা যায়। হিন্দুধর্মের শিব-পার্বতীলীলা, মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, বৈষ্ণবধর্মের শ্রীগৌরাঙ্গলীলা ইত্যাদি পটের আকর্ষণীয় বিষয়। রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী, যেমন: রামের বনবাস, সীতাহরণ, রাবণবধ, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদিও পটে অঙ্কিত হয়।



মুসলমানদের গাজীর পটে গাজীকালু-চম্পাবতীর কাহিনী কিংবা গাজী পীরের বীরত্বব্যঞ্জক বিভিন্ন অলৌকিক কর্মকান্ড অঙ্কিত হয়।এতে গাজীকে কখনও দেখা যায় সুন্দরবনের রাজার সঙ্গে লড়াই করতে; কখনও ব্যাঘ্রপৃষ্ঠে সমাসীন; কখনও মাথায় টুপি অথবা রাজমুকুট, পরনে রঙিন পাজামা কিংবা ধুতি, এক হাতে চামর বা ত্রিকোণ পতাকা এবং অন্য হাতে তলোয়ার বা মুষ্টিঘেরা জ্যোতি। গাজীর পটে মানিকপীর, মাদারপীর, সত্যপীর, কালুফকির, বনবিবি প্রভৃতি সম্পর্কে নানা অলৌকিক ক্রিয়াকর্মের ছবিও প্রদর্শিত হয়। এরূপ ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি নানা কৌতুক, রঙ্গরসসম্বলিত কাহিনী, ব্যঙ্গচিত্র এবং সামাজিক দুরবস্থার চিত্রও অঙ্কিত হয়। কখনও কখনও প্যাঁচা, বানর, গরু, বাঘ, সাপ, কুমির এবং গাছপালাও স্থান পায়। লোকধর্মে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ অনেক সময় পটুয়া এবং পটচিত্রকে ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। অনেকে গৃহে পটচিত্র সংরক্ষণ করাকে কল্যাণ এবং দৈব-দুর্বিপাক থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বলেও মনে করে।

বারো-তেরো থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলার পটুয়ারা এ শিল্পকর্ম নির্মাণে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশের ঢাকা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, বাঁকুড়া, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, হুগলি ও মেদিনীপুর ছিল এ শিল্পের প্রধান ক্ষেত্র। মানচিত্রের মতো জড়িয়ে একটি বংশদন্ডের মাথায় ঝুলিয়ে পটুয়া সঙ্গীতসহযোগে পটচিত্র প্রদর্শন করা হতো। এগুলি ছিল তখন সাধারণ মানুষের ধর্মতৃষ্ণা নিবারণ ও চিত্তবিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। পটচিত্রের সঙ্গে পটুয়া সঙ্গীতের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে; পটে যা অঙ্কিত হয়, গানের বাণীতে তাই বর্ণিত হয়। এ গান পাঁচালির ঢঙে গাওয়া হয়।

বাংলাদেশে এক সময় গাজীর পট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টির সুধীর আচার্য ছিলেন একজন খ্যাতনামা পটুয়া। তিনি ১´ × ৮´ আয়তনের গামছার ওপর ইটের গুঁড়া ও তেঁতুলের বিচির আঠায় তৈরি জমিনে লাল, কালো, হলুদ, সবুজ প্রভৃতি রঙে একটি বড় প্যানেলে বাঘের পিঠে গাজী এবং চবিবশটি ছোট ছবির খোপ অাঁকেন। এসব খোপে আছে মকরবাহিনী গঙ্গা, গাজীর আসা, খান্দুয়া বাঘ, যমদূত প্রভৃতি। যমবিষয়ক ছবির কারণে এটিকে যমপটও বলা যায়। নরসিংদীর গুনাই বেদে পটুয়া সঙ্গীত সহযোগে পট প্রদর্শন করেন। কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়াম এবং গুরুসদয় দত্ত মিউজিয়ামে একাধিক গাজীর পট রক্ষিত আছে।




আজকাল পটচিত্রের লোকজ ঐতিহ্য দ্রুত নগরায়নের ফলে ক্ষীণ হয়ে আসছে। লোকালয়ের বেশিরভাগ মানুষ এখন আরও লাভজনক পেশার কাজ বেছে নিচ্ছে। আর যারা এ ভাবে তাদের বংশানুক্রমিক পেশা ছাড়ছে তারা তাদের হিন্দু পরিচয়ও বিসর্জন দিচ্ছে।

ঋণ স্বীকার ও তথ্যসূত্র : বিভিন্ন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে