স্মৃতিতে আজও বেঁচে; প্রসঙ্গ নবাব ও মেটিয়াবুরুজ - শুভজিৎ দে

     
নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ

           যব ছোড় চলে লখনৌ নগরী...শুধু নগরী নয়। তাঁকে ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল প্রাণের চেয়ে প্রিয় অওয়ধ। নবাবি চলে যাওয়ার মুহূর্তেও চোখে জল আসেনি। কারণ মনে করতেন, একমাত্র সঙ্গীত এবং কবিতাই প্রকৃত পুরুষের চোখে জল আনতে পারে। তিনি অওয়ধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। রাজ্যহারা নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ জীবনের শেষ তিরিশ বছর কাটিয়েছিলেন কলকাতাতেই। সময় যত এগোচ্ছে, এই শহরের ওপর তাঁর সাংস্কৃতিক প্রভাব তত ফুটে উঠছে। একদা শ্রীপান্থ এই বিষয়ে প্রথম বই লিখেছিলেন, এখন আরও অনেকেই— ইংরেজি-বাংলা, দুই ভাষাতেই।

নবাবের বাড়ি পত্রিকা থেকে পাওয়া

নবাবের সমাধি

সে  উনিশ শতকের কথা। তখন বাংলা বানানে লখনউ শহরটাও ছিল অন্য রকম: ‘লক্ষ্ণৌর বাদশা কয়েদ থেকে খালাস হয়ে মুচিখোলায় আসায় শহর বড় গুলজার হয়ে উঠলো।’ লিখছেন হুতোম। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ দিয়েই মুখপাত শ্রীপান্থের ওয়াজিদ-দর্শনের। অযোধ্যার সদ্য-রাজ্যহারা নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কোম্পানির পেনশন নিয়ে লখনউয়ের কোনও প্রাসাদে নিশ্চিন্তে থাকতেই পারতেন। তা না করে ছুটলেন কলকাতা। ইচ্ছে, কাউন্সিলের কর্তাদের কাছে সওয়াল করবেন সিংহাসন উদ্ধারের জন্য। সফল না হলে যাবেন লন্ডনে, রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে। ইংরেজের ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে তাঁর মোহ তখনও কাটেনি। পরিস্থিতির চক্রব্যূহে কোনও কিছুই শেষ পর্যন্ত কাজে এল না, পেনশন নিতে রাজি হয়ে কলকাতাতেই জীবনের বাকি তিরিশটা বছর কাটিয়ে দিলেন ওয়াজিদ আলি। সেটাই হল কাল। লখনউ থেকে সরে গিয়ে মূল স্রোতের ইতিহাস থেকেও হারিয়ে গেলেন তিনি। ওয়াজিদ আলি অযোধ্যা হারালেন ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬, লখনউ ছাড়লেন সে বছরেরই ১৩ মার্চ, কলকাতা এলেন ৬ মে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জ্বলে উঠল মহাবিদ্রোহের আগুন। তখনও কলকাতায় ভাল ভাবে থিতু হননি ওয়াজিদ আলি, নিতে রাজি হননি পেনশনও। কারণ লন্ডনে তখন ‘আউধ মিশন’ সক্রিয়, তাঁর হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন মা বেগম আউলিয়া আর তাঁর সহযোগীরা। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাওয়ায় সে গুড়েও বালি পড়ল। ব্রিটিশ জনমত পুরোপুরি ঘুরে গেল ভারতীয়দের বিরুদ্ধে। এ দিকে কোম্পানির সরকার হঠাৎ মেটিয়াবুরুজের অস্থায়ী বাসস্থান থেকে গ্রেফতার করল ওয়াজিদ আলিকে। ষড়যন্ত্রের অভিযোগ একটা তোলা হয়েছিল বটে, তবে তার বিশেষ ভিত্তি ছিল বলে কেউই মনে করেন না। ওয়াজিদ নিজে বিদ্রোহ সমর্থন করেননি, লখনউয়ে তাঁর বেগম হজরত মহল ছেলে বিরজিস কদ্রকে নতুন নবাব ঘোষণা করে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলেও। আসলে পাছে বিদ্রোহীরা জোর করে ওয়াজিদকে নেতা হিসাবে তুলে ধরে, হয়তো সেই ভয়েই তাড়াতাড়ি ফোর্ট উইলিয়ামে গৃহবন্দি করা হয় তাঁকে। সেখানে থাকতে হল ২৫ মাস, বিদ্রোহ মিটে যাওয়ারও আট মাস পর তিনি ছাড়া পান। মেনে নেন পেনশনও। এই সময় থেকেই মেটিয়াবুরুজের নবাবির সূচনা। আর তাই ইতিহাসের বইয়ে বেগম হজরত মহল কি বিরজিস কদ্র যেটুকু গুরুত্ব পেয়েছেন, রাজ্যচ্যুত নবাব তা-ও পাননি।

গার্ডেনরীচ মুদিয়ালী হাই স্কুলের পাশে মমতাজ মহলের সমাধি
ফলক

তার উপর, মেটিয়াবুরুজে রাতারাতি যে ছোট লখনউ গড়ে তুলেছিলেন ওয়াজিদ আলি, তাঁর মৃত্যুর পর ততটাই দ্রুততায় তাঁর সব স্মৃতি মুছে ফেলেছিল ব্রিটিশ সরকার। সে সময়কার নবাবি দফতরের কোনও নথিপত্র রক্ষা পায়নি বললেই চলে, নবাবের লেখা কিছু বই ছাড়া। শ্রীপান্থ তাঁর ‘মেটিয়াবুরুজের নবাব’ (১৯৯০) বইয়ের ভূমিকায় সোজাসুজিই বলেছেন, ‘জানা ছিল না ইংরেজের দেওয়া মাসোহারা-নির্ভর রাজ্যহারা এই নবাব শহরের উপান্তে গড়ে তুলেছিলেন দ্বিতীয় এক লক্ষ্মৌ। অযোধ্যার রাজধানী লক্ষ্মৌর সঙ্গে অবশ্য তুলনা চলে না তার, কিন্তু এখানেও সেই রাজকীয় জৌলুস আর বিলাস। প্রাসাদ, বাগবাগিচা, চিড়িয়াখানা।’ স্বাভাবিক ভাবেই এই পর্বের ইতিহাসের উপাদান সামান্য, তাই শ্রীপান্থকে ছুটতে হয়েছে কখনও মেটিয়াবুরুজ থেকে লখনউ, কখনও লখনউ থেকে মেটিয়াবুরুজ। ফলে তাঁর বইয়ে ওয়াজিদ আলির জীবনের প্রায় অর্ধেকের কথা যেমন উঠে এসেছে, তেমনই স্পষ্ট হয়েছে দুই শহরের সাংস্কৃতিক আত্মীয়তার রূপরেখা। এর আগে বাঙালি পাঠকের কাছে এই দু’টি দিক প্রায় অজানা ছিল। সাম্প্রতিক কালে অন্তত দু’জন গবেষক এই দু’টি দিকের কাজ আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। রোজি লিউলিন জোনস তাঁর ‘দ্য লাস্ট কিং ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে মেটিয়াবুরুজের ওয়াজিদ আলিকে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সরকারি সূত্র থেকে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে। বিশেষ করে নজরে পড়ে বেগমদের সঙ্গে ওয়াজিদের সম্পর্কের বিষয়টি। রোজি সম্প্রতি কলকাতায় সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, বাংলা তিনি পড়তে পারেন না। তবে উর্দু নিয়েই স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করার ফলে ওই ভাষার অনেক সূত্র তিনি কাজে লাগাতে পেরেছেন। শ্রীপান্থ সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, হুতোমের মতো বই যে ভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন, রোজির পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। আর কলকাতায় ওয়াজিদ আলির ইতিহাস নতুন করে তৈরি করতে গেলে বাংলা সূত্র বাদ দিয়ে তা করা যাবে না। সুদীপ্ত মিত্র তাঁর ‘পার্ল বাই দ্য রিভার/ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহজ কিংডম ইন একজাইল’ বইয়ে প্রাক-মেটিয়াবুরুজ পর্বের জন্য প্রকাশিত তথ্যের উপর অনেকটাই নির্ভর করলেও আসল অংশে সমাবেশ ঘটিয়েছেন প্রচুর নতুন তথ্যের, বিশেষ করে তাঁর লক্ষ্য যেখানে শ্রীপান্থের সঙ্গে একই, অর্থাৎ কলকাতার সংস্কৃতির সঙ্গে লখনউ সংস্কৃতির যোগসূত্র অনুসন্ধান। সুদীপ্ত আর এক ধাপও এগিয়েছেন। জোর দিয়ে বলেছেন, নবাবি মেটিয়াবুরুজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তার প্রভাব হারায়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা রীতিমত দাগ রেখে গিয়েছে। তবে শ্রীপান্থ থেকে শুরু করে সকলেই অনেকটা ভরসা করেছেন আবদুল হালিম ‘শরর’কে, নবাবি মেটিয়াবুরুজ নিয়ে সংক্ষিপ্ত হলেও এত ভাল প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আর দ্বিতীয়টি নেই বলে।

ওয়াজিদ আলি শাহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মসজিদ

মসজিদের পিছন দিকে

যখন বুঝলেন বাকি জীবনটা কলকাতায় কাটাতে হবে, ঠিক কী করতে চেয়েছিলেন ওয়াজিদ আলি? রাজ্য না থাক, মোটা মাসোহারা তো আছে। ফেরত পেয়েছেন রাজকীয় গয়না, মণিমুক্তোও। তাই দিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করলেন। ‘মেটিয়াবুরুজে যেন লক্ষ্মৌর সূর্যাস্তের আভা।’ আসলে মেটিয়াবুরুজের চার দেওয়ালে ঘেরা জগৎ ছিল বাইরের পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। ওয়াজিদ আলি (১৮২২-১৮৮৭) যত দিন জীবিত ছিলেন, সেখানে টিকে ছিল মুঘল দরবারি সংস্কৃতির শেষ ছায়া। যে ছায়া খোদ এই সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র দিল্লি থেকে বিদায় নিয়েছিল ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের অনেক আগেই।

ওয়াজিদ আলি শেষ 30 বছর এই দোকানের পান খেতেন, এনার দাদুর দাদু লখনউ থেকে এসেছিলেন ও পানের দোকানি হিসেবে কাজ শুরু করেন, এই ভদ্রলোক ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. পাশ ।


মাঝের তিরিশ বছরে কত কী ঘটে গিয়েছে। ১৮৫৮-য় কোম্পানির হাত থেকে ভারত শাসনের দায়িত্ব রানির হাতে যাওয়া দিয়ে শুরু; শেষ পর্বে ১৮৮৫-তে তৈরি হয়েছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। মাঝে একের পর এক ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে কলকাতা উত্তাল। বাংলায় নবজাগরণের ঢেউ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ওয়াজিদ আলিরই সমসাময়িক। নবাব কিন্তু এ সবের বাইরে, কাছে থেকেও দূরে। পশ্চিমি কেতার প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল না। তাঁর আমলে লখনউয়ের সাংস্কৃতিক জীবনে হিন্দু-মুসলমানের পুরাণ, উপকথা, লোকগাথার বিশেষ প্রভাব। মেটিয়াবুরুজেও তা বদলায়নি।

ইমামবাড়ার ভিতরে 

ওয়াজিদের নবাবি চিহ্ন

ওয়াজিদ আলির বিরুদ্ধে কোম্পানির শাসনকর্তাদের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ইংরেজের কাছে যে যে কারণে তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই কারণগুলির জন্যই তিনি পথিকৃতের মর্যাদা পেতে পারেন। রমণীবিলাস (সারা জীবনে তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা প্রায় ৩৭৫ জন) ছাড়া তাঁর নাচ-গানে অতিরিক্ত আসক্তিই ব্রিটিশের আপত্তির প্রধান কারণ ছিল। অথচ কেউ কেউ তাঁকে হিন্দুস্তানি থিয়েটারের প্রথম নাট্যকার বলে বর্ণনা করেছেন। তখনও তিনি নবাব হননি, ১৮৪৩ সালে ভাই সিকন্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসার আয়োজন করেন ওয়াজিদ আলি। সেখানে নিজের লেখা নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেন। এই কিস্সাকেই বলা যায় প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক। কৃষ্ণ ছিলেন তাঁর রোল মডেল। যমুনাতীরে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা নবাবের চিরকালীন অনুপ্রেরণা ছিল। কৃষ্ণের রাসলীলা থেকেই লখনউয়ে ‘রহস’-এর সৃষ্টি। ওয়াজিদ আলির রহস বস্তুত অপেরা, যেখানে তিনি ব্রজ অঞ্চলে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে প্রচলিত নৃত্যের সঙ্গে নিজস্ব কত্থকের কম্পোজিশন মিলিয়েছিলেন। রহস নাটক হল নৃত্যনাট্য, যেখানে নির্দিষ্ট গল্প থাকত। লখনউয়ে নবাবির সময় ওয়াজিদ আলি মোট চারটি জলসার আয়োজন করেন, আর মেটিয়াবুরুজে ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৫-এর মধ্যে অন্তত ২৩টি। ১৮৬১ থেকে মেটিয়াবুরুজে নিয়মিত ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ হয়েছে, সেখানে তা আরও পরিণত।

ওয়াজিদ আলির লেখা বই, অন্যটি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে সংরক্ষীত 

ইতিহাস বলছে, ১৮৫৬ সালের ৬ মে কলকাতায় পৌঁছান নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। এর পর কলকাতাতেই জীবনের শেষ ৩০ বছর কাটিয়ে দেন তিনি। মেটিয়াবুরুজে রাতারাতি যে ছোট লখনউ গড়ে তুলেছিলেন ওয়াজিদ আলি, তাঁর মৃত্যুর পর ততটাই দ্রুততায় তাঁর সব স্মৃতি মুছে ফেলেছিল ব্রিটিশ সরকার। সে সময়কার নবাবি দফতরের কোনও নথিপত্র রক্ষা পায়নি বললেই চলে, নবাবের লেখা কিছু বই ছাড়া। নবাব তৈরি করেন প্রাসাদ, বাগবাগিচা, চিড়িয়াখানা। ৷ এরই সঙ্গে অওয়ধ থেকে তিনি কলকাতায় এনেছিলেন ঘুরি ওড়ানো, কবুতরবাজি ৷ এখানেই শেষ নয় ৷ এই ওয়াজিদ আলির জন্যই কলকাতা বিরিয়ানির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। তাঁর রসনা তৃপ্তির জন্যই এ শহরে ‘দমপোখ্‌ত’ বা ঢিমে আঁচে রান্না শুরু হয়। অনেকে বলেন, বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলন নাকি ওয়াজিদ আলি শাহই করেছিলেন। তবে এ বিষয়ে বিতর্কও রয়েছে। তবে বিতর্কের ধার ধারে না কলকাতার ভোজন রসিক মানুষজন। বিরিয়ানির স্বাদ-গন্ধকে অনেক আগেই এ শহরের মানুষ আপন করে নিয়েছেন। বিরিয়ানির ইতিহাস নিয়ে এখন আর তাঁরা মাথা ঘামাতে চান না।

শামিম আহমেদ এর লেখা আখতারনামার প্রচ্ছদ

ইদানীং, বিরিয়ানির প্রতি বাঙালিদের টান যেন বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। শহরের রাস্তাঘাটের আনাচে কানাচে, অলিতে গলিতে এখন বিরিয়ানির দোকান। দোকানের একশো মিটারের মধ্যে এসে পড়লেই নাকে বিরিয়ানির গন্ধ আর লাল কাপড়ে মোড়া বিরিয়ানির বিশাল হাঁড়ি চোখে পড়তে বাধ্য। আর পেটে সামান্য জায়গা খালি রয়েছে, অথচ অবলীলায় বিরিয়ানির দোকান পেরিয়ে চলে যাচ্ছেন... এমন কার সাধ্য!

তবে বাঙালির প্রিয় ‘দমপোখ্‌ত’বা ঢিমে আঁচে রান্না তিনিই নিয়ে আসেন কলকাতায়, বিশেষ করে বিরিয়ানি। বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলনও তাঁর হাতেই কি না, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। ‘কলকাতা বিরিয়ানি’র সঙ্গে ভিন রাজ্যের বিরিয়ানির ফারাক বিস্তর ৷ উপরে ছড়ানো বেরেস্তা ৷ লম্বা লম্বা সুগন্ধি চালের কোলে কাইয়ে মাখামাখি তুলতুলে খাসি ৷ আর মোলায়েম আলুর আদর ৷ সঙ্গে দেখা মেলে মুক্তোর মতো চকচকে সেদ্ধ ডিমের ৷ এমনটা তো কলকাতা ছাড়া দেখা মেলাভার! বিরিয়ানিতে হাল্কা গন্ধওয়ালা হলদেটে আলু আর ধবধবে সাদা ডিমের উপস্থিতি ছিল না প্রথম থেকে ৷ যেটা দেখা যায় ‘কলকাতার বিরিয়ানি’তে ৷ এর প্রচলনটাও কিন্তু ভারী অদ্ভুতভাবে শুরু করেছিলেন নবাব ৷

ওয়াজিদ আলি শাহর সিংহাসন

ইমামবাড়া


বিরিয়ানিতে কেন এল আলু ?

অওয়াধি বিরিয়ানি আর কলকাতা বিরিয়ানি’র মধ্যে তফাৎ একটাই ৷ আর তা হল আলু ৷ ওয়াজিদ আলি শাহ যখন কলকাতায় আসেন, তখন তাঁর কাছে তেমন অর্থ ছিল না ৷ তবে নবাবিয়ানাটা তো রক্তে ৷ তিনি ছিলেন, ‘খানে কা অউর খিলানে কা শওখিন’৷ খেতে এবং খাওয়াতে দারুণ পছন্দ করতেন তিনি ৷ কলকাতায় আসার বেশ কিছু বছর পর বিরিয়ানিতে আলুর যোগ করেন নবাব ৷

তবে শোনা যায়, সে সময় আলুর দাম কিন্তু এত কম ছিল না! পর্তুগিজরা এ দেশে নিয়ে আসে আলু ৷ এদিকে মাংসের দাম এত বেশি! বিপুল পরিমাণে মাংস কিনে বিরিয়ানি তৈরি করার ব্যয়ভারটা কিন্তু সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না কিছুতেই ৷ সেই কারণে কিছুটা খরচ বাঁচাতে, এরই সঙ্গে বিরিয়ানির পরিমাণ বাড়াতে আলুর ব্যবহার শুরু হয় ৷

আলোর সৌন্দর্য 

ওয়াজিদ আলি শাহ’র সেই বিরিয়ানির ধারা এখনও বয়ে নিয়ে চলছেন ওয়াজিদ আলি শাহ’র প্রপৌত্রী মনজিলাত ফতিমা ৷ এখনও সযত্নে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি ৷ নবাবি রেস্তোরাঁর সেই ধারা আর রান্নার প্রতি অমোঘ ভালোবাসা প্রতিটি বিরিয়ানির হাঁড়িতে ঢেলে দেন ওয়াজিদ আলি শাহ’র প্রপৌত্রী ৷ প্রতিবার বিরিয়ানির হাঁড়ি চাপানোর আগে উচ্চারিত হয়-‘বিশমিল্লাহ’৷ আল্লাহ’র নাম নিয়ে শুরু হয় রান্না ৷ হাতের জাদুতে শুরু হয় বিরিয়ানি তৈরি ৷ সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দম-এ বিরিয়ানি তৈরি ৷ দম-এ বিরিয়ানি তৈরি হওয়ার সময় নিজে তো কোনও কথা বলেনই না ৷ কাউকে কথা বলতেও দেন না মনজিলাত ৷ এক্কেবারে বংশের সেই রীতি মেনে, হেঁসেলে চলে রান্না ৷ ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতায় লাজবাব রূপ নেয় ‘কলকাতা বিরিয়ানি’৷ হাঁড়ির ঢাকনা খুলতেই বিরিয়ানির সুবাসে ম ম করে ওঠে চারপাশ ৷

তবে ওয়াজিদ আলির নাট্যপ্রয়াস কলকাতার নাটমঞ্চকে আদৌ প্রভাবিত করেছিল এমন তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু কত্থক নাচের সংস্কৃতিকে ওয়াজিদ আলি যে স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, কলকাতায় সেই লখনউ ঘরানাকে রসিক মহলে আদৃত করে তোলার পিছনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সংশয়ের বিশেষ অবকাশ নেই। ওয়াজিদ নিজে মহারাজ ঠাকুর প্রসাদের কাছে কত্থক শেখেন। ১৮৭৫-এ তিনি ‘মুসাম্মি বা বানি’ নামে কত্থক নিয়ে একটি সচিত্র বই লেখেন যা মেটিয়াবুরুজে লিথোগ্রাফ করে ছাপা হয়। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত রূপ দু’টিই আছে। বইয়ে ওয়াজিদ লিখেছেন, তাঁর সময়ে লখনউয়ে কত্থক শুধু হিন্দু শিল্পীদের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, মুসলিম শিল্পীরা একে গ্রহণ করে আরও পরিণত করেন। কলকাতায় তিনি লখনউয়ের অনেক শিল্পীকেই ডেকে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, ১৮৬৭-তে হোলির সময় মেটিয়াবুরুজের দরবারে ওয়াজিদ আলি স্বয়ং নর্তকীর বেশে নৃত্য পরিবেশন করেন, গেয়ে শোনান ঠুমরিও। কলকাতার সংগীতরসিকদের মধ্যে অঘোরনাথ চক্রবর্তী, সাজ্জাদ মহম্মদ এবং আরও অনেকে নাকি সেই অনুষ্ঠানে ছিলেন। আবদুল হালিম ‘শরর’ অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন, ওয়াজিদ নিজে কখনও নাচতেন না। লখনউ ঘরানার কত্থকশিল্পীরা ওয়াজিদের সূত্রেই কলকাতায় সমাদৃত হন।

ওয়াজিদের ব্যবহার করা জিনিস 

আর ঠুমরির তো কথাই নেই। সংগীতবেত্তা রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪) পাথুরিয়াঘাটা থেকে মেটিয়াবুরুজ যেতেন লখনউ ঠুমরির টানে। যদুনাথ ভট্টাচার্য বা যদুভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তী নবাবের দরবারি ঠুমরির রীতিমত ভক্ত ছিলেন। বস্তুত ওয়াজিদ আলির দাক্ষিণ্যে মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল ধ্রুপদী কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। লখনউয়ে ওয়াজিদ আলির দরবারেই ঠুমরি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছয়। আর মেটিয়াবুরুজ থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বুকে। নবাব নিজে কম গান লেখেননি। এমনকী দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাঙালীর গান’-এও (১৯০৬) ওয়াজিদ আলির লেখা তিনটি গান ঠাঁই পেয়েছে, সব চেয়ে বিখ্যাত বোধহয় ‘যব ছোড়ে চলে লক্ষ্ণৌ নগরী’।

মেটিয়াবুরুজে ঘুরতে আশা দর্শকদের গাইড হিসেবে ঘোরাচ্ছি

মেটিয়াবুরুজের দরবার যন্ত্রসংগীতেও তুলনাহীন। ‘তারিখ-ই-পরিখানা’-য় ওয়াজিদ লিখেছেন, তিনি বিখ্যাত সেতারি কুতুব আলি খানের কাছে সেতার শেখেন। সেনি ঘরানার উস্তাদ বসত খান মেটিয়াবুরুজে রবাব নিয়ে আসেন। সুরশৃঙ্গারও তাঁরই আনা, ওয়াজিদ এই যন্ত্রটিকে জনপ্রিয় করেন। ছিলেন বিখ্যাত বিনকার ও রবাবিয়া কাসিম আলি খান। ওয়াজিদের আহ্বানে কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দরবারে সুরবাহার বাজিয়েছিলেন। এই দরবারেই নাকি উস্তাদ নিয়ামতুল্লা খান আধুনিক সরোদ সৃষ্টি করেন। এগারো বছর তিনি ওয়াজিদ আলির কাছে ছিলেন। ওয়াজিদ তবলাকেও এ শহরে জনপ্রিয় করেন। সানাই, এসরাজের সঙ্গেও জড়িয়ে তাঁর নাম।

এখানেই শেষ নয়। ইঙ্গিত ছিল শ্রীপান্থে, সুদীপ্ত মিত্র সবিস্তারে দেখিয়েছেন, কলকাতার আরও অনেক ঐতিহ্যের সূচনাই মেটিয়াবুরুজে। আলিপুর চিড়িয়াখানার জন্ম ১৮৭৬-এ, তার অনেক আগেই নিজস্ব বিশাল চিড়িয়াখানা তৈরি করেন ওয়াজিদ আলি। সেখানে জীবজন্তুর সংখ্যা ও বৈচিত্র ছিল ঈর্ষণীয়। ‘দমপোখ্‌ত’ বা ঢিমে আঁচে রান্না তিনিই নিয়ে আসেন কলকাতায়, বিশেষ করে বিরিয়ানি। বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলনও তাঁর হাতেই কি না, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। লখনউ পানের কদর আজও কম নয়। তাম্বুলবিলাসী হলেও নবাব মদ বা আফিম স্পর্শ করেননি। 

অন্যদিকে আখতারনামায় শামিম আহমেদ বলছেন

" নটী বিনোদিনী দাসী চলে গেলে ওয়াজিদ আলি শাহ বললেন, এ বড় শোকের উপাখ্যান মালকা। ২৩ বছরে একজন শিল্পী অবসর নিয়ে নিচ্ছেন, এ আমি মানতে পারি না। মালকা জান, আমি বিনোদিনীর মুখে ঠাকুর রামকৃষ্ণের নাম শুনলাম। তুমি জানো যে আমি ভীষণ কৃষ্ণভক্ত। কে এই প্রেমের ঠাকুর রামকৃষ্ণ! আমাকে তাঁর কথা বলো।

কিশোরী গওহর জানের মা বাদশা ওয়াজিদের সভাশিল্পী বড়ে মালকা জান বললেন, সে এক সহজ ঠাকুর গো রাজা। রামের তীরধনুক কিংবা শ্রীকৃষ্ণের চক্র তাঁর হাতে নেই, মুখে আছে প্রেমের বাণী। ঠাকুর চৈতন্যদেব আর রামকৃষ্ণ ভালবাসার অস্ত্রে সকলকে কাছে টেনেছেন। চৈতন্যের ভক্তিরস জগতকে দিয়েছে সঙ্গীত আর রামকৃষ্ণের বিভঙ্গ দুনিয়াকে দান করেছে ধ্রুপদী নৃত্য। পরাজিত করে নয়, বিপক্ষকে জয়ী করে, তাঁদের সাধনপদ্ধতিকে মেনে নিয়ে ঠাকুর হয়েছেন রামকৃষ্ণ। হিন্দু ধর্ম শুধু নয় গো বাদশা, ঠাকুর নাসারা আর ইসলাম ধর্মের সব পদ্ধতি সাধন করেছেন। সুফি ওয়াজিদ আলি, সে আপনি নন, তাঁর অন্য নাম গোবিন্দ রায়, এক সময়ে পুলিশে চাকরি করতেন, তিনি ঠাকুরকে ইসলামের মজহাবে দীক্ষা দেন। দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের যে বাগান তার পাশে আছে একটি বাগিচা, আর সেই বাগানের অন্দরে রয়েছে ছোট্ট একটি মসজিদ। সেখানে ঠাকুর দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়েছেন। মুসলমানের মতো সাজ করেছেন। খাবারদাবারও খেয়েছেন তাদের মতো।

ঠাকুরের সঙ্গে নবির সংযোগের কথা তিনি নিজেই বলেছেন। খোদাতে বিলীন হয়ে যাওয়া আর লওহে মাহফুজের তন্ত্রকথায় ঠাকুর আপ্লুত। বেদ আর তন্ত্রের সমাধির সঙ্গে সুফি মুসলমানের ফানাকে তিনি অভিন্ন ঘোষণা করেছেন। এই অস্ত্র তীরধনুক আর চক্রের চেয়ে যে কত বড় তা একমাত্র প্রজ্ঞার তরবারি জানে। কুরানের সুরা আবৃত্তি করতে করতে ঠাকুর ফানায় লীন হয়ে যান।

ওয়াজিদ আলি শাহ বললেন, সেই ঠাকুরের কাছে আমি যেতে চাই। ভাসাও নৌকা। মালকা জান, আপনিও চলুন আমার সঙ্গে। ঠাকুরের সঙ্গে আমি বাংলায় কথা বলতে পারব। আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, কলকাতার এই ভঙ্গুর, এলিয়ে পড়া ধুতি সংস্কৃতিতে ঠাকুর যেন এক ঋজু শালপ্রাংশু, নারায়ণ শিলার মতো তাঁর ব্যক্তিত্ত্ব। তিনিই প্রকৃত শক্তিমান তাই তাঁর ক্ষমতার আস্ফালন নেই, আছে শক্তির স্নিগ্ধতা। প্রকৃত শক্তি শুধু প্রেম বিলোতে পারে। এই ঠাকুর আমার চাই। লাগাও নৌকা। বের করো আমার বোচা। আমি এক্ষুনি যাব বিচালি ঘাট, সেখান থেকে হাওড়া হয়ে দক্ষিণেশ্বর, কী এমন পথ!

শ্রীরামকৃষ্ণের এক গুণমুগ্ধ ভক্তের নাম আবদুল আজিজ। পেশায় চিকিৎসক। তাঁর আদি নিবাস পূর্ববঙ্গের সাতক্ষীরায়। তিনি মহেন্দ্রলাল সরকারের ছাত্র, সেই জন্য কলকাতায় থাকেন। তাঁকে সংবাদ পাঠানো হল। তিনি সশরীরে এলেন রাজাকে নিয়ে যেতে। নৌকায় উঠে তাঁকে ওয়াজিদ আলি শাহ জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি বুঝি প্রায়শই ঠাকুরের কাছে যান?...

দক্ষিণেশ্বরে নেমে আবদুল আজিজ ও রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ দেখলেন চারদিক লাল-সবুজ-গেরুয়া রঙে ভরে গিয়েছে। এক অলৌকিক জ্যোতির মধ্যে দু জন মানুষ বসে আছেন। একজন ঠাকুর, অন্যজন মণিলাল মল্লিক। তাঁদের কথোপকথন শুনলেন রাজা ওয়াজিদ আলি। রক্তমাংসের মানুষ যেন নন তাঁরা। কোন বায়স্কোপে এই ছবি দেখা যাচ্ছে তা বুঝে উঠে পারলেন না ওয়াজিদ আলি শাহ। তিনি শুনতে পেলেন--ঠাকুর বলছেন, “সেদিন কলকাতায় গেলাম। গাড়িতে যেতে যেতে দেখলাম, জীব সব নিম্নদৃষ্টি -- সব্বাইয়ের পেটের চিন্তা। সব পেটের জন্য দৌড়ুচ্ছে ।"

তিনি যদি আউধের ব্যর্থ নবাব না হতেন, তা হলে বেঁচে থাকতেন তার কাব্য প্রতিভার জন্যে । এ কথা লিখছেন একজন পশ্চিমি গবেষক । উর্দূ সাহিত্যের ইতিহাসে তার লেখা অত্যন্ত চল্লিশখানা বইএর নাম রয়েছে তার গবেষণায় । তার মধ্যে গজল, মারিস, মাসনবি, ইত্যাদির সংগ্রহ ছাড়াও রয়েছে ' সাউত-ই-মুবারিক' নামে সঙ্গীত বিষয়ক প্রবন্ধ পুস্তক । মেটিয়াবুরুজের নবাবের ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ধর্মতত্ব, সমাজতত্ব, কবিতা ও গানের নানা সংকলন । ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল (কলকাতা) নবাবের লেখা একটি বিশাল সচিত্র বই রয়েছে । মেটিয়াবুরুজে ছাপা নবাবের আর একটি বই " দুলহন " । এটি নববিবাহিত দম্পতির জন্যে নবাবের লেখা গানের সংকলন । বইটি নিয়ে বাংলায় বিস্তর আলোচনা করেছেন রাজেশ্বর মিত্র তার " মুঘল আমলের সঙ্গীত চিন্তা " বই এ । তবে বর্তমানে ওয়াজিদ আলি শাহর নাম বহু প্রচলিত গান যা এই সংগ্রহে নেই । যেমন ' যাব ছোড়ি লখনউ নগরী ', ' বাবুল মেরা নৈহর ছুটে যায় ' প্রভৃতি । এই গ্রন্থে কিছু ধ্রুপদ, সাধরা, চতুরঙ্গ, তেলেনা, ত্রিবট প্রভৃতি রয়েছে, এছড়াও আছে হোরী, চাঁচর, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরি, দাদরা, পোস্তা, প্রভৃতি শ্রেনীর গান ।ঠুমরির সংখ্যা 50 এর বেশী, দাদরাও আছে 70 টি, টপ্পার সংখ্যাও 12টির মত, এবং খেয়াল 18টি । ওয়াজিদ কূট রাগ বা তালের পক্ষপাতি ছিলেন না, অধিকাংশ রচনা পরিচিত রাগে বিন্যস্ত ।

রাজেশ্বর মিত্রের গবেষণা থেকে জানা যায়, এই গ্রন্থের মুখবন্ধ ফার্সীতে লেখা । " সুলতানে আলাম " নামে তিনি সাধারণ ভাবে পরিচিত ছিলেন । তার তখল্লুস ( ছদ্মনাম ) হচ্ছে আখতার । গানে তিনি ' আখতার প্রিয়া ' এই নামটি ব্যবহার করতেন । বাদশাহের লেখা " তারিখ-ই-পারখানা " অনুসারে জানা যায় তিনি একবার রাধা হয়েছিলেন । সঙ্গীত বা নাটকের মত নৃত্যেও ওয়াজিদের বিশেষ অবদান ছিল । তার আমলেই লখনউ এর কথৌক নাচের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে । নাচ গান কাব্য চর্চায়ে নতুন লখনউ গড়ে উঠেছিল কলকাতার উপকণ্ঠে মেটিয়াবুরুজে । ওয়াজিদের মৃত্যু 1887 সালে, ততদিনে শ্লীম্যান, উট্রাম, ডালহৌসি সবাই বিদায় নিয়েছেন এই রঙমঞ্চ থেকে ।ঐতিহাসিক এই নাটকের কুশলবীদ দের মধ্যে দীর্ঘ কাল বেঁচে ছিলেন শুধু তিনি । এবার তিনিও বিদায় নিলেন । ভাটনগর বলছেন বাদশাহের মৃত্যুদিন 1 লা নভেম্বর । তবে মনে হয় তারিখটি ঠিক নয়, কেন না ওয়াজিদ আলির মৃত্যুর পর 31 শে অক্টোবর ' ইন্ডিয়ান ডেইলি নিউজে' তার অন্তিম যাত্রার বিবরণ দিতে গিয়ে জানাচ্ছেন, শবযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন, নবাব আব্দুল লাতিফ বাহাদুর, আমীর হুসেন শাহ প্রভৃতি শহরের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি । "এ এ" নামে এক জন পত্র লেখক কলকাতার আর একটি কাগজে জানাচ্ছেন - এ বিবরণ সত্য নয় । আনোয়ার শাহ এবং কয়েকজন সাহেবজাদাকে বাদ দিলে শবযাত্রায় শহরের গণ্যমান্য কেউ উপস্থিত ছিল না । তবে পত্রলেখক স্বীকার করেন ওয়াজিদের শেষ কৃত্য সুষ্ঠুভাবে সুসম্পন্ন হয়েছে । অতঃপর ভাটনগরের বক্তব্য মিথ্যা বলে মনে হয় । বাদশাহের মৃত্যু 31 শে অক্টোবর এটাও জোর করে বলা চলে না । কারন 10 ই অক্টোবর (1887) The Statesmen কাগজে " জাস্টিন " ছদ্মনামে একজন চিঠি লিখেছেন, তাঁর চিঠির মর্ম কথা এই "... তিনি প্রয়াত ওয়াজিদ আলি শাহর প্রতি অতিশয় সংবেদনশীল, " 

ওয়াজিদ আলি শাহর সমাধি

আবার মৃত্যুর 40 দিন পর যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় সে সম্পর্কে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল । 3 'রা নভেম্বর The Statesmen পত্রের সেই চিঠি থেকে জানা যায় যে নবাবের মৃত্যু 22 অথবা 23 শে সেপ্টেম্বর হয়েছিল । তবে এ বিষয়ে বিতর্ক আছে, তবে অন্যান্য সূত্র থেকে এও জানা যায় যে নবাবের মৃত্যু হয় 1887 সালের 21 সেপ্টেম্বর। 1888 'র The Statesmen  পত্রিকায় নবাবের চিড়িয়াখানা বিক্রয়ের খবর প্রকাশিত হয়, 23 শে ডিসেম্বর 1890 বাদশাহের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় হয়েগেছে বলে জানা যায় । নদীর ধারে গার্ডেনরীচ 257 বিঘা জমি, ঘোরার গাড়িতে কলকাতা থেকে মাত্র ত্রিশ মিনিটের রাস্তা, এভাবেই কয়েক বছরের মধ্যে মুছে দেওয়া হয়েছিল নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর মনের রঙে রাঙানো মেটিয়াবুরুজ নামের রঙ্গিন ছবিটি । ইংরেজ তাঁর রাজ্য কেড়ে নিয়েছিল, কিন্তু জীবনের রস উপভোগ থামিয়ে দিতে পারেনি। চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও ওয়াজিদ আলি তাঁর জীবনচর্যায় কোনও তালভঙ্গ হতে দেননি। দেননি বলেই আমাদের সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। ওয়াজিদ আলির জীবনচর্যার উদ্ধার কোনও অস্তমিত রাজমহিমার গুণকীর্তন নয়, আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের শিকড়সন্ধান। শুধু স্বপ্নবিলাস নয়, এক অন্য জাগরণ। নবজাগরণের কলকাতায় অন্তঃসলিলা সেই জাগরণের দিকে শ্রীপান্থই আমাদের নজর ফিরিয়েছিলেন ।

https://youtu.be/pOyQ3ggwdYs
একটি তথ্যচিত্র 

তথ্যসূত্র 
1. দৈনিক পত্রিকা 
The Statesmen 23 শে ডিসেম্বর 1890
ঐ, 19 শে ও 20 শে ডিসেম্বর 1888
ঐ, 10 ই ও 31 শে অক্টোবর 1887
ঐ, 1 লা ও 3 রা নভেম্বর 1887

2. মুঘল ভারতের সঙ্গীত চিন্তা - রাজেশ্বর মিত্র

3. অযোধ্যার নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ - দিলীপকুমার মুখার্জী

4. Songs about the king of Awadh : Indian Antiquary, Vol-40 - Wiliam Crooke

5. Oudh and the East India Company (1785-1801) lucknow - P. BASU

6. মেটিয়াবুরুজে নবাব - শ্রীপান্থ

Comments

  1. Khub valo hoyeche. News ppr gulo kothay peli?🙄

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ । পেপার গুলোর গ্রন্থাগারে দেখেছি, তবে বর্তমানে ছবি নেওয়ার মত অবস্থায় নেই ।

    ReplyDelete

Post a Comment

If you have any doubt, please let me know.

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে