কলকাতায় প্রথম টেলিফোন - শুভজিৎ দে


        
( প্রথম দিকের টেলিফোন )
                   
                 ‘ক্রিং ক্রিং __ক্রিং ক্রিং ...’

         আহা কী মধুর সে শব্দ । কোনো গান নয়, বা বাদ্যযন্ত্রের অপূর্ব রাগ নয়। স্রেফ যান্ত্রিক ক্রিংক্রিং-- আর তাতেই মজে গিয়েছিল কলকাতা শহর। টেলিফোনের কী অপূর্ব অনুবাদই না হয়েছিল বাংলায়- দূরভাষ। কতরকম বিবর্তনের ভিতর দিয়ে গিয়ে, কতরকম রূপ পালটে টেলিফোন দৌড়েছিল প্রায় দেড়শো বছর। আজও চলছে বটে, তবে ধিকিধিকি। সেই দুরন্তবেগ ক্রমহ্রাসমান। 

( বৈদ্যুতিক বাতি ও টেলিফোনের বিজ্ঞাপন )


বিজ্ঞানের নানান আবিষ্কারই সমাজজীবনে ঢের পরিবর্তন এনেছে। তবে টেলিফোন সমাজজীবন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিবিড় আলাপচারিতাকে পর্যন্ত নিজের প্যাঁচানো তারে বেঁধেছিল। টেলিফোন আসায় প্রেমের বয়ান গেল বদলে। প্রেমপত্রের অধীর অপেক্ষা গিয়ে ঠেকল ক্রিংক্রিং- ধ্বনিমাধুর্যে। গোটা বিশ্বও যেন সেই এক ধ্বনিতে বাঁধা। কলকাতা তো বটেই।  

( Morce Code টেলিগ্রাফ যন্ত্রে ব্যবহৃত সংকেত )
( টেলিগ্রাফ যন্ত্রে )

১৮৭৬ সালে গ্রাহাম বেল টেলিফোন আবিষ্কার করেন। বেলসাহেবের সেই বেল খুব দ্রুতই বিশ্বময় জনপ্রিয় হয়ে যায়। কলকাতায় বা ভারতে তখন টেলিগ্রাফের রমরমা। তবু, ১৮৭৯-তে লন্ডনে টেলিফোনের সাফল্য দেখে অনেক ইংরেজ ব্যবসায়ীও সেই ব্যবস্থাকে কলকাতায় নিয়ে আসতে চাইলেন। ইন্ডিয়ান টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেড, বা দ্য অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কোম্পানি লিমিটেড- আর্জি জানালেন সরকারের কাছে। পাছে টেলিগ্রাফের ব্যবসা মার খায়, তাই সেসময় দূরভাষের ছাড়পত্র মেলেনি। কিন্তু ১৮৮১ সালেই অবস্থা বদলায়। ইংল্যান্ডের আন্তর্জাতিক টেলিফোন ব্যবসায়ী সংস্থা ‘দি ওরিয়েন্টাল টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেড’ ব্রিটিশ সরকারের ছাড়পত্র আদায় করে। ১৮৮১ সালের ১৫ নভেম্বর শর্তসাপেক্ষে ভারতে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বানানোর ছাড়পত্র দেয় সরকার। ওরিয়েন্টাল কোম্পানি কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে প্রথম তা স্থাপন করে। কলকাতার ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল দক্ষিণে উলুবেড়িয়া থেকে উত্তরে নৈহাটি পর্যন্ত টেলিফোন লাইন পাততে পারবে কোম্পানি। তবে এই টেলিফোনীয় যোগাযোগের সমস্ত স্বত্ব কিন্তু তখনো সরকারের। সেজন্যই কাউন্সিল হাউজ  স্ট্রিটের ৭ নম্বর বাড়ির চারতলায় প্রথম সেন্ট্রাল এক্সচেঞ্জ স্থাপিত হয়। 


 কাউন্সিল হাউজ  স্ট্রিটের ৭ নম্বর বাড়ি )


ভারতবর্ষে টেলিফোনের প্রথম যুগের গ্রাহক ছিল মাত্র পঞ্চাশ জন। সেই তালিকায় বাঙালি ছিল একজনই- শিবকৃষ্ণ দাঁ এন্ড কোং- এর তৎকালীন মালিকপক্ষ। আর ১৮৮২ সালে সেই গ্রাহক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪ জনে। ব্যক্তিগতভাবে যে বাঙালি প্রথম টেলিফোন ব্যবহার করেন, তিনি বাবু সাগরলাল দত্ত। পেশায় তিনি ব্যবসায়ী। কলুটোলার কাছে ১৪ নম্বর গোপালচন্দ্র লেনে ছিল তাঁর বসবাস। কলকাতায় প্রথম টেলিফোন গাইড বেরিয়েছিল ১৮৮২ সালে। তখন অবশ্য তার পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১। ক্রমশ সেই গাইড স্ফীতোদর হতে থাকে। পরবর্তীকালে সেই বিপুল বিশাল গাইডের চেহারা আমরা দেখেছি। ১৯২৪ সালের গাইডে মিলবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফোন নম্বর। স্যার রবীন্দ্রনাথ টেগোর- বড়োবাজার ১৯৪৫। আর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের নম্বর ছিল দক্ষিণ -৬১৮। শান্তিনিকেতনে টেলিফোন শুরু হওয়ার দিনে তো রীতিমতো আড়ম্বর লেগে গিয়েছিল। কবিতা শুনিয়ে টেলিফোন কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজে। 


( এই চিত্রটির শেষে যে ব্যক্তি আছেন তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

( ওরিয়েন্টাল টেলিফোন কোম্পানির প্রাথমিক পর্বের গ্রাহক ও তাদের নাম্বার )


অনেকগুলো বছর টেলিফোন জুড়ে ছিল কলকাতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে। অনেক গল্প, সিনেমা জুড়ে এই টেলিফোন। তাতে  ক্রস কানেকশনের জমাটি গল্প। সে যেন এক মজার দুনিয়া। একসময়, সরাসরি নম্বর ঘুরিয়ে অন্য নম্বরে ফোন করা যেত না। কল অপারটের নামক সেতুটি পেরিয়েই যেতে হত তখন। পরে অবস্থা বদলাল। এর মধ্যেও দীর্ঘদিন গোটা পাড়ার একটা বাড়িতেই টেলিফোন। সেখানে পাড়ার লোকের অবিরল যাতায়াত। কিংবা রাস্তার মোড়ের টেলিফোন বুথ। আর তারপর এসটিডি, আইএসডি- কতকিছু  জড়িয়ে এক রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্য, এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশ- টেলিফোনের তার দৌড়াচ্ছে। 

( আধুনিকতার দিকে পা বাড়িয়ে ডায়াল টেলিফোন )

অবশেষে সেখানেও ছেদ এল। মোবাইল এসে ল্যান্ডফোনের একচেটিয়া বাজারে গভীর থাবা নামিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মেইল, হোয়াট্স্যাপ, মেসেঞ্জার- সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট। ক্রিংক্রিং শব্দের আর কী দরকার! এখন ল্যান্ডফোন এসে দাঁড়িয়েছে শুধু অফিসঘরের কাজে। সেসবে আর ক্রস কানেকশন হয় না। চিৎকার করে বারবার জানতে চাইতে হয় না- এটা  ‘২৪৪-১১৩৯’ কিনা।  

( অত্যাধুনিক সুবিধা যুক্ত মোবাইল )


কলকাতার একসময়ের নস্টালজিয়া টেলিফোনের আসর মুঠোফোনের (বাংলাদেশ এ ব্যবহৃত মোবাইলের বাংলা অনুবাদ ) তোড়ে হারিয়ে গেল। একেবারে চোখের সামনে দিয়ে।

( টেলিফোন সৃষ্টিকর্তার হাতে তার নিজের সৃষ্টি ও আধুনিক মোবাইল )

Comments

Post a Comment

If you have any doubt, please let me know.

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে