দুর্গাকাহিনী : একটি প্রাসঙ্গীক আলোচনা - শুভজিৎ দে

" আকাশে বাতাসে ভাসে আগমনীর সুর,
সেই সুরে মিলে যায় দূর হতে দূর, "

দেবী দুর্গা 

স্মৃতির স্মরণি বেয়ে অতীতে গেলে মনে হবে বর্তমনে দুর্গাপূজা তার নব কলেবরে, সাজ সজ্জায়, চিন্তা চেতনায় পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে উৎসবে পরিণত হয়েছে। মন্ডপ সজ্জায় এসেছে থিম, সাযুজ্য রেখে পরিবর্তন এসেছে মূর্তির গঠনেও। একচালার সাবেকি দুর্গা, ও তার পরিবার আজ তিন বা পাঁচ চালায় বিভক্ত নিউক্লিয়ার পরিবারের মতো। তবে দুর্গাপূজার মাহাত্ম বাঙালির কাছে সেই একই আছে, তা সে দেশে হোক, বা বিদেশে, সাবেকি পোষাকে হোক, বা আধুনিক পোষাকে, আর দুর্গাপুজো মানেই কাশফুল, ঢাকের তাল, আগমনীর সুর, সেই সুরে মত্তো হয়ে জেনে নেওয়া যাক অতীতের কিছু কথা।

দেবী দুর্গার প্রাচীন মূর্তি

মা দুর্গার প্রতি বাঙালির একটি অধিকারবোধ জন্মে গিয়েছে, যদিও এই শরৎকালের দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন রামচন্দ্র, তার রাজত্ব ছিল উত্তর ভারতে, কিন্তু সমগ্র উত্তর ভারতের মানুষ দুর্গাপূজার থেকে দশেরাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। সেক্ষেত্রে দেবী দুর্গার বাঙালিকরণ কীভাবে ঘটছে তা একটি প্রশ্ন।

দেবী দুর্গার প্রাচীন মূর্তি

দুর্গাপূজা প্রসঙ্গে হিন্দুশাস্ত্রে ও ইতিহাসে অসংখ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, আর সেখানেই প্রশ্ন ওঠে দেবীদুর্গা আর্যজাতির দেবী না অনার্যের, বৈদিক না অবৈদিক, প্রাগৈতিহাসিক যুগে কি তার পুজোর প্রচলন ছিল কি না তার উত্তর খোঁজা। যার জন্য দুর্গার অস্তিত্ব বিষয়ক প্রশ্নে গবেষকরা এখনও একমত নন, হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথাল প্রভৃতি স্থান থেকে যেসব প্রত্নসমগ্রি পাওয়া গেছে তার থেকে মনে হয় সেই সময়ে দেবী পূজার প্রচলন ছিল। ধ্বংসস্তূপ থেকে পাওয়া সিলমোহরে আঁকা নগ্ন নারীমূর্তিটিকে শক্তিরূপিনী দেবীর নিদর্শন বলে মনে করা হয়। মহাকাব্যের দিকে তাকালে দেখা যাবে বাল্মীকির রামায়ণে দুর্গার উল্লেখ না থাকলেও মহাভারতের বিরাট ও ভীষ্ম পর্বে দুর্গাপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যদিকে দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পুজোর প্রচলন ছিল বলে জানা যায়।

দেবী দুর্গার অঙ্কিত চিত্র, 
যেখানে বাহন সিংহের স্থানে বাঘ

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে ভারতে দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপের প্রচলন হয়। ঋগবেদে কোথাও দুর্গাপূজা প্রসঙ্গে আলোচনা নেই, অন্যদিকে মার্কন্ডেয় পুরানে দুর্গার অসুর বধের উল্লেখ আছে, তৈত্তিরীয় আরন্যক, কলিকাপুরান প্রভৃতিতে দেবী দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও চৈতন্য সমসাময়িক রঘুনন্দন তাঁর তিথিতত্ত্ব (দ্বিমতে দুর্গাপূজাতত্ত্ব) গ্রন্থে দুর্গোৎসবতত্ত্ব নিয়ে লিখে গিয়েছেন, বিদ্যাপতি, সন্ধাকর নন্দী, বৃন্দাবন দাস প্রমুখের লেখায় দুর্গোৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়।

দেবী দূর্গার প্রাচীন মহিষমর্দিনী মূর্তি

দেবী দুর্গাকে শস্যের দেবী রূপে উল্লেখ করা হয়েছে চন্ডীতে, দুর্গাকে সেখানে বিষ্ণুমায়া বলে উল্লেখ করে সেখানে বলা হয়েছে, ' যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি সংস্থিতা ', বরাহ পুরানে বলা হয়েছে বিষ্ণুমায়া শস্য ও জলের দেবী, এদিক থেকে দেখলে প্রাচীন সমাজে শস্যদেবীর পূজা প্রচলিত ছিল বিভিন্ন সভ্যতায় যারা ছিলেন দুর্গতিনাশিনী, এ প্রসঙ্গে ট্যাসিটাসের বক্তব্য - Nearly all the German unite in warshpping Nerthus, that is to say Mother Earth. এই শস্যদেবীই আর্যঅনার্য সংস্কৃতির মিলনে দুর্গাদেবীতে পরিণত হয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন।

দেবী দুর্গার প্রাচীন মূর্তি

দেবীদুর্গার প্রতিমা সূর্য দেবতা থেকে কল্পিত হলেও তাকে আজকের রূপে উপস্থিত হতে যেতে হয়েছে বৃক্ষ, যূপ, স্তূপ, স্তম্ভ, প্রভৃতির মধ্য দিয়ে। প্রতীক থেকে প্রতিমার রূপে উপস্থিত হতে তাকে (দেবী দুর্গা) পেরিয়ে আসতে হয়েছে বিবর্তনের অনেকটা পথ, প্রতীককে দেবীরূপে পুজো করার চল এদেশে বহু প্রাচীন, যেমন ঘটে দেবীকে আহ্বান করে প্রতীক রূপে কল্পনা করা হয়। ঘট ছাড়াও নানা প্রতীকে দেবী পূজা হতে দেখা যায়। দেবী দুর্গার মৃত্তিকা ও প্রস্তর অবয়বে আত্মপ্রকাশ হয় গুপ্তযুগে।

চার্লস কোলমান সাহেবের 1832 সালে প্রকাশিত বই " মিথলজি অফ দ্য হিন্দুস "

তবে তার রূপভেদ নিয়েও মতভেদ আছে, প্রাচীন যেসব মূর্তি বা গুহাচিত্র পাওয়া গেছে তাতে কিন্তু দেবী একাকিনী, কোনো পরিবারবর্গ নেই, প্রাচীন মহিষমর্দিনী মূর্তিগুলি দেখলেই তা বোঝা সম্ভব। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেবীর দুই পাশে দুটি নারীমূর্তি দেখা যায় এরা লক্ষী-সরস্বতী নাকি জয়া-বিজয়া তা নিয়ে মতপার্থক্য রযেগেছে। এছাড়াও দেবীর হাতের সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক রযেগেছে, দুই থেকে শুরু করে সহস্রভুজা দুর্গার মূর্তিও উৎখননে প্রাপ্ত হয়েছে বলে। কোথাও কোথাও দেবীর বাহন সিংহ, আবার কোথাও বাঘ, অঞ্চলভেদে এই পর্থ্যক লক্ষণীয়।

টেরেকোটার কাজ

বাংলায় প্রথম কে কবে দুর্গাপূজা প্রচলন করেন সে বিষয়ে বিতর্ক আছে, জানা যায় রাজা সুরথ প্রথম দুর্গাপূজা করেন (সত্যযুগে), তবে বাংলায় ঠিক কবে থেকে পুজো শুরু হয় তার নির্দিষ্ট কোনো তারিখ বলা অসম্ভব, মুঘল বাংলায় বারো ভুঁইয়ার একজন, রাজ পুরোহিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শে রাজা কংসনারায়ণ আনুমানিক 500 বছর আগে এই দুর্গাপুজোর সূচনা করেন, রমেশ শাস্ত্রীই কংসনারায়ণকে লক্ষী, গনেশ, কার্তিক, সরস্বতী নিয়ে দেবী দুর্গার একটি প্রতিমার পরিকল্পনা করে দেন, যেমনটা আজ আমরা দেখে থাকি, রাজা কংসনারায়ণ এই পুজোর জন্য সেই সময়ে তৎকালীন প্রায় আট লক্ষ টাকা খরচ করেন, প্রকৃত পক্ষে তিনি ছিলেন সৌখিন ও গুণের পৃষ্ঠপোষক, তাঁরই রাজসভায় সভাকবি ছিলেন কৃত্তিবাস, যার লিখিত রামায়ণে প্রথম দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়, এবং তাঁর হাত ধরেই দেবী দুর্গার বাঙালিকরণ ঘটেছে।

সাবেকি একচালায় দেবী দুর্গা, 
বাগবাজার সার্বজনীনের

কংসনারায়ণের দেখাদেখি তখনকার রাজাদের মধ্যে এই দুর্গাপূজা নিয়ে একে অপরকে টেক্কা দেওয়া প্রতিযোগীতা শুরু হয়, যা বর্তমানের পুজো কমিটি গুলির মধ্যে লক্ষণীয়। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, কলকাতার জমিদার গোবিন্দরাম মিত্র, শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব, প্রচুর জাঁকজমকপূর্ণ করে দুর্গাপূজার প্রচলন করেন, পরবর্তীকালে ধনী সম্প্রদায়ের মধ্যে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার প্রবণতার কারণে পুজোর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়, এদের মধ্যে উল্লেখ্য সাবর্ণ রায়চৌধুরির বাড়ির পুজো, বড়ানগরে বংশীদত্তের বাড়ির পুজো, রামদুলাল দে'র বাড়ির পুজো প্রভৃতি। এর মধ্যে এক অভিনব বিষয় ঘটলো 1890 সালে, এবার কোনো বাবুর পুজো নয়, হুগলির গুপ্তিপাড়ায় 12 জন বন্ধু মিলে শুরু করলেন দুর্গাপূজা, সেখান থেকেই বারোয়ারি কথাটির উৎপত্তি।

দেবী দুর্গার অঙ্কিত চিত্র

তবে সাবেকি একচালার চালচিত্র থেকে কবে কীভাবে পাঁচচালা আসে তা জানা যায় কুমোরটুলি সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটির সদস্য সৌরভ দত্তর থেকে। তার তথ্যানুযায়ী পাঁচ চালচিত্রে দেবী দূর্গা পরিবর্তিত হয় 1938 সালে কুমোরটুলি সার্বজনীনের হাত ধরে। সেই বছর পুজো সমিতির সভাপতি ছিলেন নেতাজি, পঞ্চমীর সন্ধ্যায় হঠাৎ মন্ডপে আগুন লাগলে পুজো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন নেতাজি এবং প্রতিমশিল্পী গোপেশ্বর পাল চিন্তা-ভাবনা করে রাতারাতি প্রতিমা বানান। তবে তা একচালার চালচিত্রে নয়, পাঁচ চালায়। ভিন্ন পাঁচজন শিল্পী এক রাতেই সেই পাঁচটি মূর্তি তৈরী করেন।

1938 সালে কুমোরটুলি সার্বজনীন
 পাঁচ চালায় দেবী দুর্গা

এছাড়াও 2017 সালে তাদের পুজোর থিম সঙ্গীতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠে একটি এগারো মিনিটের আবৃত্তি শোনা যায়, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে -

" ভাঙন এলো চালচুলো বিহীন, দুর্গা এলো ঘরে, "

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্ঠে 
কুমোরটুলি সার্বজনীনের থিম সঙ্গীত

কলকাতায় প্রাচীনতম দুর্গামূর্তিটি নিমকাঠের তৈরী, এটি চিৎপুরের চেতেশ্বরী মন্দিরে রয়েছে। এক ডাকাত এই পূজা করতেন। 1926 সালে কলকাতায় প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপূজা হয়। সিমলা ব্যাম সমিতিতে। বর্তমানে নানা রং এর আলোর ঝলকানি, ছুটির আমেজ, ভিড়ে ঠাসা রাজপথ, বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যাওয়া দেওয়ালের মাঝে দুর্গাপূজা নয়, দুর্গোৎসব চলে মহালয়ার দিন থেকেই।

অলোক সজ্জায় কলকাতার রাজপথ



তথ্যসূত্র

• দেবী দুর্গার প্রাচীনতা - দেবাশিস সাহা
• দেবী দুর্গা : উৎস বিস্তৃতি ও বৈচিত্র - মানস ভাণ্ডারী
• দুর্গার বিবর্তন - দেবযানী বসু
• বাঙালি রূপেন সংস্থিতা - সায়ন দে
• বাংলার দুর্গাপূজা ও তার ইতিহাস - দেবলীনা দত্ত দে
• দুর্গাপূজার বিবর্তন পুরান থেকে ইতিহাস - রূপেশ সামন্ত
• কলকাতার দুর্গাপুজোর স্মৃতি - গোবিন্দ ঘোষাল

পত্রিকা

• দুর্গাপূজার ইতিহাস - এই সময়

সহায়ক গ্রন্থ

• দেবী দুর্গা স্বরূপ ও সন্ধান
- সম্পাদনা দেবাশিস সাহা ও আদিত্য মুখোপাধ্যায়
• বাঙালির দুর্গা - আদিত্য মুখোপাধ্যায়

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে