সুরের জাদুকর ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান - শুভজিৎ দে

ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেব

যার কাছে ধর্ম কোনো দিন প্রাধান্য পায়নি, যিনি মন্দিরে নিয়মিত সঙ্গীত চর্চা করতেন, যার সানাইয়ের সুর ছাড়া কোনো শুভ বিবাহ সম্ভব নয়, যার কাছে সঙ্গীতই ছিল ধর্ম, আর তিনি হলেন ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেব, 21 শে মার্চ 1916 সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় সানাই বাদক। ভারতের উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে এক অবিস্মরণীয় নাম। সানাইকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বাদনের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে এই অমর শিল্পী ভারতের উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে ওস্তাদ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে তিনি তৃতীয় যাঁরা ভারতরত্ন পদক পেয়েছেন। তিনি ছিলেন অল্পসংখ্যক গুণীদের মধ্যে একজন যিনি ভারতের চারটি সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকে সম্মানিত হয়েছেন।

ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেব 
সঙ্গীত পরিবেশন করছেন

সানাইকে ভারতের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত জগতের যন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার একক কৃতিত্ব ভারতের উচ্চাঙ্গ ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেবের। 1937 সালে কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে সানাই বাজিয়ে একে ভারতীয় সঙ্গীতের মূল মঞ্চে নিয়ে আসেন। 1950 সালের 26শে জানুয়ারি দিল্লীর লাল কেল্লায় অনুষ্ঠিত ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবসে বিসমিল্লাহ খান সাহেব তার অন্তরের মাধুরী ঢেলে রাগ কাফি বাজিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন সারা ভারতবর্ষকে।

ওস্তাদ সাহেবের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি

তার যোগ্যতায় সানাই এবং ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেব সমার্থবোধক হয়ে গেছে। ভারতীয় দূরদর্শনের 15 ই অগাষ্টের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে তার সানাই বাদন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল। দিল্লীর লাল কেল্লায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর পরই ভারতীয় দূরদর্শন সানাই গুরুর অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করতো। পন্ডিত নেহেরুর সময় হতেই এই ঐতিহ্য চলে আসছে।

রাগ দুর্গা তিন তাল
ভিডিও সৌজন্যে T-Series, YouTube

আফগানিস্তান, ইউরোপ, ইরান, ইরাক, কানাডা, পশ্চিম আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপান, হংকং-সহ পৃথিবীর প্রায় সকল রাজধানী শহরেই ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেব তার সঙ্গীত প্রভা ছড়িয়েছেন।

এতো সুনাম এবং অর্জন সত্ত্বেও অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন খান সাহেব। সবসময়ই ছিলেন বারাণসীর পুরোনো পৃথিবীতে। সাইকেল রিকশাই ছিল তার চলাচলের মূল বাহন। অত্যন্ত অন্তর্মুখী বিনম্র এই সঙ্গীত গুরু বিশ্বাস করতেন যে সঙ্গীত শোনার বিষয়, দেখার বা দেখাবার নয়। তিনি সারা জীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখ্য - ভারতরত্ন (2001), পদ্মবিভূষণ (1980), পদ্মভূষণ (1968), পদ্মশ্রী (1961), সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কার (1956), তানসেন পুরস্কার, মধ্য প্রদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ততালার মৌসিকী, ইরান প্রজাতন্ত্র 1992, সঙ্গীত নাটক একাডেমীর ফেলো (1994)

2001 সালে ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেবকে 
ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত করছেন রাষ্ট্রপতি কে. আর. নারায়ানান

ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান সাহেব স্বাধীনতা উত্তর ভারতের উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন। ব্যক্তিস্বত্তা হিসেবে তিনি হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।

তাঁর অবিস্মরণীয় উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ হচ্ছে, 

  • সনাদি অপন্যা চলচ্চিত্রের ডা: রাজকুমার চরিত্রের জন্য সানাই বাজানো
  • গুঞ্জে উঠে সানাই (1959) সানাই বাজানো
  • মায়েস্ট্রো চয়েস (ফেব্রুয়ারি 1994)
  • মেঘ মালহার, ভলিয়ুম 4 (কিশোরী আমনকরের সাথে) (সেপ্টম্বর ১৯৯৪)
  • লাইভ এট কুইন এলিজাবেথ হল (সেপ্টেম্বর 2000)
  • লাইভ ইন লন্ডন, ভলিয়ুম 2 (সেপ্টেম্বর 2000) 

সানাইয়ের এই দিকপাল 21 অগাষ্ট 2006 তারিখে বারাণসীর হেরিটেজ হসপিটালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়েস হয়েছিল 90। আজ তাঁর 14 তম মৃত্যুবার্ষিকী।

তথ্যসূত্র : বিভিন্ন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম
চিত্রঋণ : Wikipedia

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে