সমস্যার সূত্রপাতে বিতর্কিত এই কালাপানি - শুভজিৎ দে

বিতর্কিত অঞ্চল
চিত্রঋণ - www.bbc.com

কালাপানি অঞ্চল ভারত ও নেপালের মধ্যকার বিতর্কিত একটি অঞ্চল যা উত্তরাখণ্ডের পিথোরাগড় জেলায় অবস্থিত বর্তমানে ভারত প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অঞ্চলটি হিমালয়ের কালী নদীর অন্যতম প্রধান জলপথ কালাপানি বা শার্দা নদী দ্বারা চিহ্নিত যার উচ্চতা ৩৬০০-৫২০০ মিটার পর্যন্ত। কালাপানি উপত্যকাটির সর্বোচ্চ চূড়া লিপুলেখ পাস যার মধ্য দিয়ে প্রাচীন তীর্থস্থান যাত্রার কৈলাস-মানস সরোবরপথ তৈরি হয়েছে। পথটি উত্তরাখণ্ডের ভুতিয়া গোত্রদের দ্বারা তিব্বতে বাণিজ্য করার অন্যতম সড়ক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। কালী নদী পশ্চিম দিকে ভারত এবং নেপালকে বিভক্ত করেছে। তবে ভারত দাবী করে, নদীর তীরবর্তী শাখাসমূহ সীমানায় অন্তর্ভুক্ত নয়। সীমানাটি জলবিভাজিকার সাথেই অবস্থিত। ভারতের এই অবস্থানটি ব্রিটিশ ভারতের সময় অনুমানিক ১৮৬৫ থেকে চলে আসছে।

এই অঞ্চলের কাছেই টিঙ্কার পাস নামে নেপালের আরো একটি পাস রয়েছে। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় ভারত লিপুলেখ পাসটি বন্ধ করে দিলে অধিকাংশ বাণিজ্য টিঙ্কার পাস দিয়ে সংগঠিত হত।১৯৯৭ সালে যখন ভারত ও চীন উভয়ে লিপুলেখ পাসটি উন্মুক্ত করে দিতে সম্মত হয় তখন নেপাল কালাপানি অঞ্চল নিয়ে বিরোধীতা শুরু করে। বর্তমান সময়ে নেপাল কালাপানি নদীর পুরো অঞ্চলই তাদের বলে দাবী করে। নেপাল তাদের সরকারি মানচিত্রে এই অঞ্চলের ৩৫ বর্গ কিলোমিটার তাদের দারচুলা জেলার অর্ন্তভূক্ত হিসেবে দেখায়। ভারত ও নেপালের যৌথ কমিটি ১৯৯৮ সাল থেকে এই অঞ্চলসহ আরো কয়েকটি বিতর্কিত অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণে কাজ করছে। কিন্তু এখনো দুই পক্ষ কোন যৌথভাবে সম্মত হতে পারেনি। 

কিছুদিন আগেই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী (৮ই মে) যখন ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে চীনের তিব্বত সীমান্তের লিপুলেখের সাথে সংযুক্তকারী ৮০ কিলোমিটার লম্বা একটি রাস্তা উদ্বোধন করেন তখন তিনি হয়ত ধারণাও করেননি যে এ নিয়ে প্রতিবেশী দেশ নেপালের সাথে এত বড় সংকট তৈরি হবে। রাস্তাটি উদ্বোধনের সাথে সাথে নেপাল প্রতিবাদ জানায়, " যে এলাকার মধ্য দিয়ে এই রাস্তা নেওয়া হয়েছে তার অনেকটাই তাদের। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই এই জায়গার ভেতর দিয়ে ভারতের এই রাস্তা তৈরি তারা কখনই মানবে না। "

ভারতে অনেকের কাছেই এখন প্রশ্ন হচ্ছে - এত বড় পদক্ষেপ নেপাল কেন নিচ্ছে ? রাস্তাটি তো রাতারাতি তৈরি হয়নি, নেপাল তা বহুদিন ধরেই দেখছে যে ভারত রাস্তাটি তৈরি করছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের সেনাপ্রধান এম এম নারাভানে তো সরাসরি বলেই ফেলেছেন এক বিবৃতিতে যে, " তৃতীয় একটি দেশ হয়তো নেপালকে উস্কে দিয়েছে। " মুখে না বললেও তিনি যে চীনের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন তা অনুমেয়। ভারতে অনেক পর্যবেক্ষক এই একইরকম সন্দেহ করছেন। 

নেপাল দাবি করে ১৮১৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে এক চুক্তি অনুযায়ী কালি নদীর পূর্বাঞ্চল তাদের, কিন্তু ভারত সবসময় কালি নদীর উৎস এবং তার নদীর প্রবাহ বদলে যাওয়াসহ এই অঞ্চলের ওপর তাদের অধিকার নিয়ে নানা প্রমাণ হাজির করেছে। তাছাড়া, ভারত গত ৬০ বছর ধরেই এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানে তাদের সেনা মোতায়েন রয়েছে। বহু অবকাঠামো তৈরি করেছে তারা।

অন্য দিকে হিমালয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে গবেষণাধর্মী একটি বই লিখেছেন কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী। তিনি বলছেন, " লিপুলেখ সীমান্ত এলাকা নিয়ে ভারত ও নেপালের এই নজিরবিহীন বিরোধের পেছনে নেপালে রাজতন্ত্র পরবর্তী রাজনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ভারতকে চ্যালেঞ্জ করে যেভাবে তারা মানচিত্র বদলের পথে গেছে, সেটা যেন অনেকটা ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স। স্বাধীনতার ঘোষণার মতো। "

এদিকে চীনের সাথে সীমান্তে সামরিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে, বাণিজ্যিক দিক দিয়ে গুরুত্বের বিবেচনায় এবং এর ধর্মীয় দিক থেকে প্রতীকী গুরুত্ব বিবেচনা করে, ভারত হয়তো কখনই এলাকার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ ছাড়বে না। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতকে এই সমস্যা সমাধান করতে হবে, নাহলে চীন একটা সময় এখানে নাক গলাতেই পারে। এখন পর্যন্ত চীন চুপ, কিন্তু ভবিষ্যতে অঙ্ক বদলে যেতেই পারে স্বাভাবিক ভাবেই। কালাপানি নিয়ে বিরোধ, ২০১৭ সালের ভুটান সীমান্তে ডোকলাম সঙ্কটের রূপ নিতেই পারে (অনুমেয়)।

২০১৭ সালে ডোকলামে রাস্তা নির্মাণ নিয়ে ভুটান এবং চীনের মধ্যে বিরোধ শুরু হলে ভারত সেখানে গিয়ে সৈন্য মোতায়েন করে। কালাপানির মালিকানা নিয়ে চীন হয়তো কখনই সরাসরি মাথা গলাবে না, কিন্তু পেছন থেকে নেপালকে কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমর্থন জোগাতেই পারে। সে ক্ষেত্রে বিষয়টির সমাধান করা তখন সত্যিই কঠিন হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয়।

তথ্যসূত্র


Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে