ন' দশক পার, এখনও Not-Out : হাওড়ার বড়ঘড়ি - শুভজিৎ দে

একাধিক সাহিত্যে , বহু বাংলা সিনেমায় এই বড় ঘড়িকে দেখানো হয়েছে। আসলে বাঙালির জীবনে এই ঘড়ি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছে। অসংখ্য গল্প আর নস্টালজিয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বড় ঘড়িকে ঘিরে। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তো বড়ঘড়ি বেশ জড়িয়ে আছে। হবু স্ত্রী এর সঙ্গে দেখা করার জায়গা ছিল তো এই বড় ঘড়ি। আসলে বড় ঘড়ি যে, আস্তে আস্তে আমাদের জীবনে ল্যান্ডমার্কের থেকেও অনেক বড় নস্টালজিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহুবার আমি নিজেও যখন কবাডি খেলার জন্য বাইরে যেতাম, তখন ফোন না থাকায়, আগের দিন মাঠে অনুশীলন শেষে সতীর্থ সবাইকে বলে দিতাম এখানে অপেক্ষা করতে। ফোন ব্যবহার শুরু করলেও কলেজের বিভাগীয় ভ্রমণের জন্য সব জুনিয়র দের এখানেই অপেক্ষা করতে বলি, এই জায়গাটা থেকেই যেন এই অঞ্চলের জি.পি.এস. সিস্টেম শুরু হয়।

বছর কয়েক আগে 2010 নাগাদ একবার কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হলেও দ্রুত তা মেরামত করা হয়। ঘড়িটি স্থাপনের 94 বছর পরেও এতদিন ধরে অক্লান্তভাবে সঠিক সময় দিয়ে চলেছে আজও। দেখা যায়, এখনও অনেক যাত্রী নিজেদের ঘড়ির সময় বড় ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নেন। পাশাপাশি 9 দশকের বেশি সময় ধরে অসংখ্য মানুষের মিলনস্থল হিসেবেও স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাওড়া স্টেশনের ঐতিহ্যবাহী এই ‘বিগ বেন’। 

বড়ঘড়ি

জানা যায়, এই ঘড়ির ডায়ালের ব্যাস 3 ফুট 9 ইঞ্চি। ছোট কাঁটা অর্থাৎ ঘন্টার কাঁটা দেড় ফুট বা 18 ইঞ্চি লম্বা। আর বড় কাঁটা বা মিনিটের কাঁটার দৈর্ঘ্য দু ফুট অর্থাৎ 24 ইঞ্চি। 1975 সালে ঘড়িটি মেকানিক্যাল থেকে ইলেকট্রো মেকানিক্যালে রূপান্তরিত করা হয়। তার পরে রিচার্জেবল ব্যাটারির সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় ঘড়িটি। 

পূর্ব রেল সূত্রে জানা যায়, 1926 সালে এই ঘড়িটি হাওড়া স্টেশনের পুরনো কমপ্লেক্সের শতাব্দী প্রাচীন ভবনে বসানো হয়। পিঠোপিঠি অবস্থিত এই ঘড়িটির একটি মুখ আছে 1 থেকে 8 নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে এবং অন্যটি 9 থেকে 15 নম্বর প্ল্যাটফর্মমুখী। 

বড়ঘড়ি

লোহার মজবুত ফ্রেমের ওপর স্থাপিত এবং স্টেশন ম্যানেজারের অফিসের পাশের দেওয়ালের সঙ্গে সংযুক্ত এই ঘড়ি ‘জেন্টস’ নির্মিত। লন্ডনের বিখ্যাত বিগ বেন ঘড়িও বিলিতি ঘড়িবাবু এডওয়ার্ড জন ডেন্টের এই সংস্থারই তৈরি। আগে বিদ্যুৎ চালিত যান্ত্রিক হাওড়ার এই বড় ঘড়িটিতে একটি দূরনিয়ন্ত্রক পালসার যন্ত্রের মাধ্যমে দম দেওয়া হতো এবং সময়ের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা হতো। পরবর্তীকালে বিদ্যুৎ পরিবাহী তারে সমস্যা তৈরি হয়। এখন আর এই ঘড়িতে চাবি ঘুরিয়ে দম দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তার ব্যবস্থা করা আছে ঘড়ির ভেতরেই। 

হাওড়া স্টেশনে এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়, পরিচিত ও খ্যাতনামা ল্যান্ডমার্ক। 1926 সাল থেকে কত প্রেম, মান-অভিমান, সম্পর্ক ভাঙা-গড়া, আরও কত শত সহস্র অজস্র ঘটনার নীরব সাক্ষী। হাওড়া স্টেশনের ‘বিগ বেন’, থুড়ি, বড় ঘড়ি। প্রাক-মোবাইল যুগে যাত্রীরা পরিচিতদের খুঁজে নিতেন এই বড় ঘড়ির নীচে দেখা করে। এমনকি এখনও জিপিএসের যুগেও যাত্রীদের কাছে এর অবদান অনস্বীকার্য। শুধু হাওড়ার ‘বড় ঘড়ি’ বললেই মিটিং লোকেশন চিনে নেন তাঁরা। এককথায় অলিখিত অ্যাসেম্বলি পয়েন্ট। কত যে সিনেমার শুটিং হয়েছে তা বলে বা লিখে শেষ করা যাবে না, তাই পরিশেষে বলা যেতেই পারে সলিল চৌধুরীর কথায়, 
"এই রোকো
পৃথিবীর গাড়িটা থামাও
আমি নেমে যাব
আমার টিকিট কাটা অনেক দূরে
এ গাড়ি যাবে না
আমি অন্য গাড়ি নেব"

অনেক ট্রেন আসবে যাবে, উন্নত হবে শহর, উন্নত হবে শহরতলি, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক হবে প্রযুক্তি, ক্রীতদাস হয়ে উঠবো আমরা, তবুও যখন হাওড়াগামী হবে আমাদের পা, তখন পকেটে রাখা ঘড়ির বদলে না হয় একবার বড়ঘড়িই দেখে নেওয়া যাবে ।

বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাই সপ্তর্ষি দা কে,

তথ্যসূত্র

বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে