বাংলার স্থাপত্যকীর্তি : চালা মন্দির শৈলি - শুভজিৎ দে
প্রাচীন কাল থেকে আমাদের দেশে সৌধ নির্মাণের প্রথা অব্যাহত রয়েছে। নগরায়ণের অনিবার্য অঙ্গ হিসেবে উপাসনার ক্ষেত্রেও স্থাপত্যরীতি গড়ে উঠেছে। প্রাচীন কাল থেকে নির্মিত অনেক সৌধ প্রাকৃতিক কারণে কিংবা বিরুদ্ধবাদীদের আঘাতে বর্তমানে নিশ্চিহ্ন প্রায়। যদিও বিরুদ্ধমতাবলম্বীদের আচরণে বৈপরীত্যের নজির অতীতেও যেমন ছিল, বর্তমানেও তেমন আছে। যেমন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের বিষ্ণুমন্দির নির্মাণে অকুণ্ঠ সহয়তা; হিন্দু ও মুসলিম শাসক কর্তৃক মঠ-মন্দির, দরগা নির্মাণে সহয়তাদান ইত্যাদি।
বাংলার চারিদিকে ছড়িয়ে আছে সোনালি ফসলের ক্ষেত্র অথবা উঁচুনিচু অনুর্বর প্রান্তর ও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বনভূমি। প্রবাহমান নদী-নালার জলধারায় সঞ্জীবিত ভূভাগের স্থানে স্থানে আজও চোখে পড়ে নানান ধর্মীয় ইমারত। কালের প্রবাহে অযত্ন ও কংক্রিটের জঙ্গলে কর্মব্যস্ত মানুষ ডুব দেওয়ায় সেসব স্থাপত্যসৌধের অধিকাংশ জীর্ণ হয়ে পড়লেও যেগুলি টিকে আছে, তার থেকে অনুমান করা যায় প্রাচীন বাংলার জীবনচর্চা ও শৈল্পিকবোধের পরিচয়। পরবর্তীকালে মূলত খ্রিস্টিয় পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলায় নবপর্যায়ে মন্দির নির্মাণের সূত্রপাত হয় এবং সেই ধারাবাহিকতা বিংশ শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত বজায় থাকে। মূলত শ্রীচৈতন্য প্রভাবিত বৈষ্ণবধর্ম অন্দোলনের প্রভাবেই যে এই পুনরুজ্জীবনের প্রধান কারণ সেকথা মন্দিরগবেষকগন স্বীকার করে নিয়েছেন। এই নবপর্যায়ে নির্মিত মন্দিরের গঠনরীতির রূপরেখা অনেকটাই নির্ভর করে মন্দিরের ওপরের অংশের আচ্ছাদন সংক্রান্ত নির্মাণকৌশলের ওপর। আর সেই করণেই এই আচ্ছাদনরীতির বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করেই মন্দিরের প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। আচ্ছাদন সহ গঠনরীতি অনুসারে নবপর্যায়ে নির্মিত এই মন্দির গুলিকে প্রধানত পাঁচটি স্থাপত্যরীতিতে ভাগ করা যায়, যথা - চালা, রত্ন, শিখর বা রেখ, পীঢ়া বা দেউল ও দালান স্থাপত্যরীতি। এছড়াও বাংলার মন্দির স্থাপত্যে মিশ্ররীতির প্রভাবও দেখা যায়। শিখররীতি ও পীঢ়ারীতি বাংলায় প্রাচীন কালে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। তবে নবপর্যায়ে শিখররীতির মন্দির নির্মাণে যথেষ্ট রূপভেদ দেখা যায়। চালা, রত্ন ও দালান - এই তিনরীতির উদ্ভব হয়েছে সম্পূর্ণ আঞ্চলিক প্রতিভার ভিত্তিতে যা বাংলার কোনো আখ্যাত স্থপতির সৃষ্ট কারিগরি প্রযুক্তির এক অপূর্ব নিদর্শন।
-: বাংলার মন্দিররীতি :-
● চালা - একচালা, দো (দুই) চালা, জোড়বাংলা, চারচালা, আটচালা এবং বারোচালা
● রত্ন - এক রত্ন, পঞ্চ রত্ন, নব (নয়) রত্ন, ত্রয়োদশ রত্ন, সপ্তদশ রত্ন, একবিংশ রত্ন এবং পঞ্চবিংশ রত্ন
● শিখর - নগরদেউল, পীঢ়াদেউল, বঙ্গীয় শিখরশৈলি
● দালান - একতলা, দোতলা (দ্বিতল)
● পীঢ়া
● মিশ্র
বিভিন্ন মন্দিররীতি চিত্রে দেখানো হয়েছে
বাংলার স্থাপত্য কীর্তি : চালা স্থাপত্য রীতি -
বাংলায় মন্দির স্থাপত্যের ক্ষেত্রে নিজেস্ব স্থাপত্যরীতি হল 'চালা স্থাপত্যরীতি'। এই চালা আবার বিভক্ত ছিল ছয় ভাগে। ফলে এই চালারীতি ছিল যথেষ্ট বৈচিত্র্যপুর্ণ। যার জন্য বাংলার মন্দির স্থাপত্যকীর্তি বিশেষ উৎকর্ষের দাবি রাখতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন পরবর্তীকালে আমরা যে সুলতানী ও মুঘলস্থাপত্যের চাকচিক্য ও রমরমা দেখি সেখানেও সগর্বে বিরাজ করেছেন বাংলার মন্দির স্থাপত্যরীতির স্থপতিগণ। নিম্নে বাংলার এই 'চালা স্থাপত্য' নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার মন্দির স্থাপত্যরীতির একটি বিশিষ্ট দিক তুলে ধরার চেষ্টা করা হল।
একচালা বা তিনচালা -
গ্রামবাংলায় বাঁশ ও খড় দিয়ে সহজে ও সংক্ষিপ্তভাবে তৈরি হয় একচালা যা একটি ত্রিভুজের আকৃতিতে উঁচু দেওয়াল থেকে নেমে আসে। স্থানীয় ক্ষেত্রে একে বা এই ধরনের চালাকে বলা হয়ে থাকে "পরচালা"। সাধারণত মাটির চারচালা বা আটচালা ঘরের সামনের দাওয়া বা বারান্দাটিকে রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই একচালা বা পরচালার প্রয়োজন হয়।
বহুক্ষেত্রে বাঙালি ঘরামি মিস্তিরিদের হাতে পড়ে এই একচালাটির দুইপাশের ফাঁকা অংশ ঢাকা দেবার প্রয়োজনে বাড়তি চালা সংযোগ করায় সেটি হয়ে দাঁড়ায় তিনচালা। মন্দির রূপকল্পনায় এই রীতি যে অনুসরণ করেননি বঙলি স্থপতিরা এমন নয়, বেশকিছু শিখর বা আটচালা মন্দিরের সামনের দিকে প্রয়োজনে অকিঞ্চিৎকর মুখমন্ডল হিসাবে এই রীতির ব্যবহার হয়েছে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে সেটি একচালার মত দেখতে হলেও স্থাপত্যগত কারণে তা তিনচালার রূপ নেয়। এ জাতীয় স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যায় মেদিনীপুর জেলার নোয়াদার রাধাগোবিন্দ মন্দিরের (1860 খ্রি:) ক্ষেত্রে।
দোচালা বা একবাংলা -
পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে খড়ে ছাওয়া দোচালারীতির সাধারণ কুটির অজস্র দেখা যায়। তবে দোচালারীতির যথার্থ নিদর্শন পাওয়া যায় সেকেলে দুর্গাপূজার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের খড়ে ছাওয়া চন্ডীমন্ডপ স্থাপত্যের মধ্যে। তখনকার মিস্তিরিদের তৈরি করা এই খড়ে ছাওয়া বাঁকানো চালের দোচালা চন্ডীমন্ডপকে বলা হত 'পাটাকুমারী'। সেদিক থেকে দোচালা কুঁড়েঘরের এই আদলকে বা শিল্পশৈলীকে মন্দির স্থপতিরা অনুসরণ করে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপ দিয়েছেন দোচালা মন্দির নির্মাণে। এখানে উল্লেখ্য যে, একটি আলোচনাচক্রে বক্তৃতা রাখার সময় বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ সত্যকাম সেন তাঁর বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে বলেন " মানুষ যেভাবে তার জীবনযাপন করেন, তিনি তাঁর ভগবানকেও সেইভাবেই দেখতে চান। এই বক্তব্যেরই প্রতিফলন এই চালাশিল্প রীতিতে প্রকাশ পেয়েছে।
অন্যদিকে ঐ শৈলীর মন্দিরকে 'একবাংলা' নামেও অভিহিত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বাংলার এই কুঁড়েঘর শুধু যে মন্দির স্থপতিদের প্রভাবিত করেছিল তা নয়। বাংলার জলবায়ুর উপযোগী এই গৃহশৈলীর অনুকরণ করার জন্য সেগুলির নামকরণও করা হয় 'বাংলো' বা 'ডাকবাংলো' । একই সাদৃশ্যের কারণে দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে নির্মিত দেবায়তন গুলিও বাংলারীতি থেকে 'একবাংলা' নামে অভিহিত হয়েছে। এ রীতির মন্দিরগুলি আয়তাকার কুঠুরিযুক্ত চার দেওয়ালের দুপাশে কারিগরি দক্ষতায় আয়তাকার দুটি আচ্ছাদন চাল নেমে আসে। লক্ষণীয় বিষয় হল আয়তাকার চাল দুটির কার্নিশ হয় ধনুকের মত বাঁকানো। বাঘডাঙার সূর্যেশ্বরমন্দির এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
জোড়বাংলা-
দুটি দোচালা স্থাপত্যকে পাশাপাশি স্থাপিত করে নির্মিত মন্দিরকেই বলা হত জোড়বাংলা মন্দির। বলা যেতেই পারে এই জোড়বাংলা শৈলী পূর্ববর্ণিত দোচালারীতিরই একটি পরিবর্তিত ও উন্নততর রূপ। এই শৈলীর অন্তর্ভুক্ত দুটি আয়তাকার দোচালা স্থাপত্যের সমান্তরাল অবস্থান শেষ পর্যন্ত মন্দিরের আসনটিকে বর্গাকারে পরিণত করে। জোড়বাংলার সামনে ত্রিখিলান প্রবেশ পথের মাঝামাঝি পিছনের দেওয়ালেও একটি ঘেরা দেওয়ালপথ রাখা হত। যাতে পরবর্তী দোচালা কুঠুরিতে প্রবেশ করা যায় এবং সেখানেই অধিষ্ঠিত হতেন মন্দিরের উপসিত বিগ্রহ। অন্যদিকে এই মন্দির স্থাপত্যটিকে সুদৃশ্য করার জন্য বাংলার শিল্পীরা চালের ওপর সমান দূরবর্তী স্থানে প্রতিস্থাপন করত তিনটি ক্ষুদ্রকার চূড়া যার ধরনটি হত অবিকল খোড়োঘরের মটকায় নিবদ্ধ প্রথাগত খড়ের আঁটির গোড়ার দিকের অংশের মত। আবার কখনও কখনও দুটি চালার মধ্যবর্তী স্থানে নির্মাণ করা হত চারচালা বা আটচালা অথবা নবরত্নরীতির ক্ষুদ্রাকার স্থাপত্যসৌধ। পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রাচীন জোড়বাংলা স্থাপত্যের উদাহরণ হল হুগলি জেলার গুপ্ত পড়ার চৈতন্যদেবের মন্দির।
চারচালা-
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগ্রামান্তরে বসবাসের কুটির হিসেবে সর্বাধিক দেখতে পাওয়া যায় চারচালাছাদ বিশিষ্ট মাটির বাড়ি। বলা যেতে পারে দোচালাছাদের স্বাভাবিক পরিণতি ঘটেছে এই চারচালার, যার সংক্ষিপ্ত ও সহজরূপ প্রকাশ করার ক্ষমতাও যেন বেশী এই রীতির কুটিরের। চারিদিকের দেওয়ালে নেমে আসে সমত্রিভুজাকৃতির চারটি ঢালুচাল। যার নীচের বহিঃরেখটি হয় ধনুকের মত বাঁকানো। এই চারচালা কুটিরের আদলে বাঙালি স্থপতিরা যে রীতির মন্দির নির্মাণের প্রচেষ্টা শুরু করেন, সেই রীতির মন্দিরের চারিদিকের চালে নমনীয় বক্ররেখাটির বন্ধন এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যা সৌন্দর্য বৃদ্ধির একান্ত সহায়ক। এই স্থাপত্য শৈলীর একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির হল ঘাটালের সিংহবাহিনীর চারচালা মন্দির। সাধারণত এই চারচালা মন্দিরের ভিত্তিভূমি হয় বর্গাকার এবং প্রবেশপথও হয় একদুয়ারি। একদুয়ারি চারচালার এই উদাহরণ ছাড়াও ত্রিখিলান প্রবেশপথ যুক্ত চারচালার দৃষ্টান্ত দেখা যায়।
আটচালা-
বাংলার আটচালা কুটির হল চারচালা কুটিরের পরবর্তী পর্যায়। বঙ্গীয় মন্দির স্থপতিরা প্রথাগত আটচালা কুঁড়েঘরের অনুকরণে নির্মাণ করেছেন আটচালারীতির মন্দির। এই রীতির মন্দির প্রসঙ্গে আসার আগে, খোড়োঘরের আদলে মন্দির নির্মাণরীতি নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে যে শুধুমাত্র সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্যই এই স্থাপত্য ভাবনটির সৃষ্টি হয়নি; এর পিছনে ছিল বহু পরিশ্রম, নির্মাণ ও কৌশলগত পরিকল্পনা যা স্থপতির কারিগরি চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল।
প্রাচীনকালে দুর্গাপূজার স্থান হিসাবে যে দোচালা চন্ডীমন্ডপ নির্মিত হত তার সামনের চত্বরে স্থাপিত হত একটি আটচালা মন্ডপ। যেখানে পুথিপাঠ, নৈবেদ্য প্রকরণ এর প্রস্তুতি চলত; বাকি অংশে দর্শক ও শ্রোতারা সমবেত হতেন। চারচালার বদলে স্থপতিরা কেন এহেন আটচালামন্ডপ তৈরি করতেন তার এক যুক্তিগ্রাহ্য কারণ এখানে দেওয়া যেতে পারে। বহু শ্রোতার একত্রে বসার প্রয়োজনে নির্মিত এই মণ্ডপটি চারচালা হিসেবে তৈরি করতে হত। তার আয়তন অনুযায়ী ওপরের চালকে করতে হবে খুব উঁচু এবং সেই সুউচ্চ প্রশস্ত কাঠামোটি বাঁশকাঠ দিয়ে তৈরি হওয়ার ফলে তেমন সুদৃঢ় না হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যেত। এই সব অসুবিধা বিবেচনা করে বাংলার স্থপতিগন উদ্ভাবন করলেন আটচালারীতির। প্রথমে ভূমিনকশার মধ্যে উঁচু করে চারচালা এবং পরে সেই চারচালার ঢালের সঙ্গে সমতা রেখে এবং চালের সামান্য নীচু থেকে চারিদিকে ফাটাচাল জুড়ে দিয়ে তৈরি হয় আটচালাস্থাপত্য। প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয় স্তরটি অপেক্ষাকৃত আয়তনে ছোটো হত। এই রীতি কেবলমাত্র বহিরঙ্গ সজ্জার সৌন্দর্যবৃদ্ধি আবার কোথাও কোথাও উচ্চতা অর্জনের জন্য নির্মিত হত। উল্লেখ করার বিষয় এই রীতির প্রকরণের মন্দিরের ক্ষেত্রে ওপরের ও নীচের চালগুলির কার্নিশ হয় সাধারণত চারচালার মতন এবং এই শৈলীর অধিকাংশ মন্দিরের গর্ভগৃহের সম্মুখভাগে দেখা যায় ত্রিখিলানযুক্ত দালান। আবার কোথাও দালান ছাড়াই একদুয়ারি প্রবেশপথ থাকে। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে আটচালামন্দিরের বিভিন্নতা দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে একক আটচালামন্দির ছাড়াও পাশাপাশি নির্মিত জোড়া আটচালামন্দিরও দেখা যায় যা সাধারণ্যে জোড়া মন্দির নামে পরিচিত।
বারোচালা-
গ্রামবাংলার বহুস্থানে আটচালার মত বারোচালার কুটিরও দেখা যায়। যার অনুকরণে মন্দির স্থপতিরা বারোচালারীতির মন্দির নির্মাণেও মুখফিরিয়ে নেননি। ভূমিনকশায় বারোচালার মন্দির আটচালার মতনই বর্গাকার এবং আটচালার ওপরভাগে তৃতীয় স্তরে আর একটি অপেক্ষাকৃত ছোটো চারচালা নির্মাণ করে সেটিকে বারোচালার রূপ দেওয়া হত। তবে এই রীতির মন্দির সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে খুব কম।
গ্রামীন মানুষের অবহেলা ও ঔদাসীন্যে এবং বঙ্গীয় কৃষ্টির এই মহামূল্যবান প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অজ্ঞতার দরুণ উপযুক্ত রক্ষণাবক্ষেণের অভাবে বহু মন্দির ও স্থাপত্য আজ বিলুপ্ত এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সামান্যতম সংস্কার না করার ফলে আজ বেশ কিছু মন্দির বা স্থাপত্য ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এইসব কৃষ্টির রক্ষণাবক্ষেণের দায়িত্ব আজ (আমরা) অস্বীকার করতে পারি না।
গ্রামবাংলায় বাঁশ ও খড় দিয়ে সহজে ও সংক্ষিপ্তভাবে তৈরি হয় একচালা যা একটি ত্রিভুজের আকৃতিতে উঁচু দেওয়াল থেকে নেমে আসে। স্থানীয় ক্ষেত্রে একে বা এই ধরনের চালাকে বলা হয়ে থাকে "পরচালা"। সাধারণত মাটির চারচালা বা আটচালা ঘরের সামনের দাওয়া বা বারান্দাটিকে রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই একচালা বা পরচালার প্রয়োজন হয়।
বহুক্ষেত্রে বাঙালি ঘরামি মিস্তিরিদের হাতে পড়ে এই একচালাটির দুইপাশের ফাঁকা অংশ ঢাকা দেবার প্রয়োজনে বাড়তি চালা সংযোগ করায় সেটি হয়ে দাঁড়ায় তিনচালা। মন্দির রূপকল্পনায় এই রীতি যে অনুসরণ করেননি বঙলি স্থপতিরা এমন নয়, বেশকিছু শিখর বা আটচালা মন্দিরের সামনের দিকে প্রয়োজনে অকিঞ্চিৎকর মুখমন্ডল হিসাবে এই রীতির ব্যবহার হয়েছে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে সেটি একচালার মত দেখতে হলেও স্থাপত্যগত কারণে তা তিনচালার রূপ নেয়। এ জাতীয় স্থাপত্যের নিদর্শন দেখা যায় মেদিনীপুর জেলার নোয়াদার রাধাগোবিন্দ মন্দিরের (1860 খ্রি:) ক্ষেত্রে।
দোচালা বা একবাংলা -
পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে খড়ে ছাওয়া দোচালারীতির সাধারণ কুটির অজস্র দেখা যায়। তবে দোচালারীতির যথার্থ নিদর্শন পাওয়া যায় সেকেলে দুর্গাপূজার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের খড়ে ছাওয়া চন্ডীমন্ডপ স্থাপত্যের মধ্যে। তখনকার মিস্তিরিদের তৈরি করা এই খড়ে ছাওয়া বাঁকানো চালের দোচালা চন্ডীমন্ডপকে বলা হত 'পাটাকুমারী'। সেদিক থেকে দোচালা কুঁড়েঘরের এই আদলকে বা শিল্পশৈলীকে মন্দির স্থপতিরা অনুসরণ করে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপ দিয়েছেন দোচালা মন্দির নির্মাণে। এখানে উল্লেখ্য যে, একটি আলোচনাচক্রে বক্তৃতা রাখার সময় বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ সত্যকাম সেন তাঁর বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে বলেন " মানুষ যেভাবে তার জীবনযাপন করেন, তিনি তাঁর ভগবানকেও সেইভাবেই দেখতে চান। এই বক্তব্যেরই প্রতিফলন এই চালাশিল্প রীতিতে প্রকাশ পেয়েছে।
অন্যদিকে ঐ শৈলীর মন্দিরকে 'একবাংলা' নামেও অভিহিত করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বাংলার এই কুঁড়েঘর শুধু যে মন্দির স্থপতিদের প্রভাবিত করেছিল তা নয়। বাংলার জলবায়ুর উপযোগী এই গৃহশৈলীর অনুকরণ করার জন্য সেগুলির নামকরণও করা হয় 'বাংলো' বা 'ডাকবাংলো' । একই সাদৃশ্যের কারণে দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে নির্মিত দেবায়তন গুলিও বাংলারীতি থেকে 'একবাংলা' নামে অভিহিত হয়েছে। এ রীতির মন্দিরগুলি আয়তাকার কুঠুরিযুক্ত চার দেওয়ালের দুপাশে কারিগরি দক্ষতায় আয়তাকার দুটি আচ্ছাদন চাল নেমে আসে। লক্ষণীয় বিষয় হল আয়তাকার চাল দুটির কার্নিশ হয় ধনুকের মত বাঁকানো। বাঘডাঙার সূর্যেশ্বরমন্দির এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
জোড়বাংলা-
দুটি দোচালা স্থাপত্যকে পাশাপাশি স্থাপিত করে নির্মিত মন্দিরকেই বলা হত জোড়বাংলা মন্দির। বলা যেতেই পারে এই জোড়বাংলা শৈলী পূর্ববর্ণিত দোচালারীতিরই একটি পরিবর্তিত ও উন্নততর রূপ। এই শৈলীর অন্তর্ভুক্ত দুটি আয়তাকার দোচালা স্থাপত্যের সমান্তরাল অবস্থান শেষ পর্যন্ত মন্দিরের আসনটিকে বর্গাকারে পরিণত করে। জোড়বাংলার সামনে ত্রিখিলান প্রবেশ পথের মাঝামাঝি পিছনের দেওয়ালেও একটি ঘেরা দেওয়ালপথ রাখা হত। যাতে পরবর্তী দোচালা কুঠুরিতে প্রবেশ করা যায় এবং সেখানেই অধিষ্ঠিত হতেন মন্দিরের উপসিত বিগ্রহ। অন্যদিকে এই মন্দির স্থাপত্যটিকে সুদৃশ্য করার জন্য বাংলার শিল্পীরা চালের ওপর সমান দূরবর্তী স্থানে প্রতিস্থাপন করত তিনটি ক্ষুদ্রকার চূড়া যার ধরনটি হত অবিকল খোড়োঘরের মটকায় নিবদ্ধ প্রথাগত খড়ের আঁটির গোড়ার দিকের অংশের মত। আবার কখনও কখনও দুটি চালার মধ্যবর্তী স্থানে নির্মাণ করা হত চারচালা বা আটচালা অথবা নবরত্নরীতির ক্ষুদ্রাকার স্থাপত্যসৌধ। পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রাচীন জোড়বাংলা স্থাপত্যের উদাহরণ হল হুগলি জেলার গুপ্ত পড়ার চৈতন্যদেবের মন্দির।
চারচালা-
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগ্রামান্তরে বসবাসের কুটির হিসেবে সর্বাধিক দেখতে পাওয়া যায় চারচালাছাদ বিশিষ্ট মাটির বাড়ি। বলা যেতে পারে দোচালাছাদের স্বাভাবিক পরিণতি ঘটেছে এই চারচালার, যার সংক্ষিপ্ত ও সহজরূপ প্রকাশ করার ক্ষমতাও যেন বেশী এই রীতির কুটিরের। চারিদিকের দেওয়ালে নেমে আসে সমত্রিভুজাকৃতির চারটি ঢালুচাল। যার নীচের বহিঃরেখটি হয় ধনুকের মত বাঁকানো। এই চারচালা কুটিরের আদলে বাঙালি স্থপতিরা যে রীতির মন্দির নির্মাণের প্রচেষ্টা শুরু করেন, সেই রীতির মন্দিরের চারিদিকের চালে নমনীয় বক্ররেখাটির বন্ধন এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যা সৌন্দর্য বৃদ্ধির একান্ত সহায়ক। এই স্থাপত্য শৈলীর একটি উল্লেখযোগ্য মন্দির হল ঘাটালের সিংহবাহিনীর চারচালা মন্দির। সাধারণত এই চারচালা মন্দিরের ভিত্তিভূমি হয় বর্গাকার এবং প্রবেশপথও হয় একদুয়ারি। একদুয়ারি চারচালার এই উদাহরণ ছাড়াও ত্রিখিলান প্রবেশপথ যুক্ত চারচালার দৃষ্টান্ত দেখা যায়।
আটচালা-
বাংলার আটচালা কুটির হল চারচালা কুটিরের পরবর্তী পর্যায়। বঙ্গীয় মন্দির স্থপতিরা প্রথাগত আটচালা কুঁড়েঘরের অনুকরণে নির্মাণ করেছেন আটচালারীতির মন্দির। এই রীতির মন্দির প্রসঙ্গে আসার আগে, খোড়োঘরের আদলে মন্দির নির্মাণরীতি নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে যে শুধুমাত্র সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্যই এই স্থাপত্য ভাবনটির সৃষ্টি হয়নি; এর পিছনে ছিল বহু পরিশ্রম, নির্মাণ ও কৌশলগত পরিকল্পনা যা স্থপতির কারিগরি চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল।
প্রাচীনকালে দুর্গাপূজার স্থান হিসাবে যে দোচালা চন্ডীমন্ডপ নির্মিত হত তার সামনের চত্বরে স্থাপিত হত একটি আটচালা মন্ডপ। যেখানে পুথিপাঠ, নৈবেদ্য প্রকরণ এর প্রস্তুতি চলত; বাকি অংশে দর্শক ও শ্রোতারা সমবেত হতেন। চারচালার বদলে স্থপতিরা কেন এহেন আটচালামন্ডপ তৈরি করতেন তার এক যুক্তিগ্রাহ্য কারণ এখানে দেওয়া যেতে পারে। বহু শ্রোতার একত্রে বসার প্রয়োজনে নির্মিত এই মণ্ডপটি চারচালা হিসেবে তৈরি করতে হত। তার আয়তন অনুযায়ী ওপরের চালকে করতে হবে খুব উঁচু এবং সেই সুউচ্চ প্রশস্ত কাঠামোটি বাঁশকাঠ দিয়ে তৈরি হওয়ার ফলে তেমন সুদৃঢ় না হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যেত। এই সব অসুবিধা বিবেচনা করে বাংলার স্থপতিগন উদ্ভাবন করলেন আটচালারীতির। প্রথমে ভূমিনকশার মধ্যে উঁচু করে চারচালা এবং পরে সেই চারচালার ঢালের সঙ্গে সমতা রেখে এবং চালের সামান্য নীচু থেকে চারিদিকে ফাটাচাল জুড়ে দিয়ে তৈরি হয় আটচালাস্থাপত্য। প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয় স্তরটি অপেক্ষাকৃত আয়তনে ছোটো হত। এই রীতি কেবলমাত্র বহিরঙ্গ সজ্জার সৌন্দর্যবৃদ্ধি আবার কোথাও কোথাও উচ্চতা অর্জনের জন্য নির্মিত হত। উল্লেখ করার বিষয় এই রীতির প্রকরণের মন্দিরের ক্ষেত্রে ওপরের ও নীচের চালগুলির কার্নিশ হয় সাধারণত চারচালার মতন এবং এই শৈলীর অধিকাংশ মন্দিরের গর্ভগৃহের সম্মুখভাগে দেখা যায় ত্রিখিলানযুক্ত দালান। আবার কোথাও দালান ছাড়াই একদুয়ারি প্রবেশপথ থাকে। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে আটচালামন্দিরের বিভিন্নতা দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে একক আটচালামন্দির ছাড়াও পাশাপাশি নির্মিত জোড়া আটচালামন্দিরও দেখা যায় যা সাধারণ্যে জোড়া মন্দির নামে পরিচিত।
বারোচালা-
গ্রামবাংলার বহুস্থানে আটচালার মত বারোচালার কুটিরও দেখা যায়। যার অনুকরণে মন্দির স্থপতিরা বারোচালারীতির মন্দির নির্মাণেও মুখফিরিয়ে নেননি। ভূমিনকশায় বারোচালার মন্দির আটচালার মতনই বর্গাকার এবং আটচালার ওপরভাগে তৃতীয় স্তরে আর একটি অপেক্ষাকৃত ছোটো চারচালা নির্মাণ করে সেটিকে বারোচালার রূপ দেওয়া হত। তবে এই রীতির মন্দির সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে খুব কম।
গ্রামীন মানুষের অবহেলা ও ঔদাসীন্যে এবং বঙ্গীয় কৃষ্টির এই মহামূল্যবান প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অজ্ঞতার দরুণ উপযুক্ত রক্ষণাবক্ষেণের অভাবে বহু মন্দির ও স্থাপত্য আজ বিলুপ্ত এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সামান্যতম সংস্কার না করার ফলে আজ বেশ কিছু মন্দির বা স্থাপত্য ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এইসব কৃষ্টির রক্ষণাবক্ষেণের দায়িত্ব আজ (আমরা) অস্বীকার করতে পারি না।
Khub valo lekha hoyeche...☺️👍
ReplyDeleteধন্যবাদ বন্ধু ।
Delete