তিলোত্তমা শহরের চার্চনামা - শুভজিৎ দে

কলকাতা শহরে খ্রিষ্টানদের উপাসনার জন্যে প্রথম যে বাড়িটি তৈরি হয়েছিল তা কোনও গির্জা নয়, ছোট একটা উপাসনাগৃহ৷ এখনকার জিপিও-রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অঞ্চলে ছিল ইংরেজদের প্রথম কুঠি ও দুর্গ৷ তার মধ্যেই ছিল সেই উপাসনাগৃহ৷ তার পর বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছে আর্মেনিয়ান চার্চ (১৭০৭), সেন্ট অ্যান’স চার্চ (১৭০৯), মিশন চার্চ (১৭৭০), সেন্ট জন্ স্ চার্চ (১৭৮৭), পর্তুগিজ চার্চ (১৭৯৯), সেন্ট অ্যান্ড্রূজ চার্চ (১৮১৮), সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল (১৮৪৭), সেন্ট জেমস চার্চ (১৮৬৮), সেন্ট মেরিজ চার্চ (১৮৮৭), গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ (১৯২৫) আরও অনেক গির্জা৷ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যে সমৃদ্ধ কলকাতায় আজও নজর কাড়ে বেশ কিছু গির্জা। বড়দিনের আগে থেকেই এগুলি আলোকমালায় সেজে উদাসী শীতের মরসুমে আবারও শহরে উৎসবের মেজাজ ফিরিয়ে আনে। কলকাতায় বড়দিন উৎসব ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল সে কথা সঠিক ভাবে জানা না গেলেও, অনুমান করা হয় খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা এ দেশে আসার পর থেকেই উপাসনার জন্য তৈরি হয়েছিল প্রার্থনাকক্ষ। তবে ইংরেজরা এ দেশে আসার অনেক আগেই খ্রিস্টধর্মাবলম্বী আর্মেনিয়ান ও পর্তুগিজরা বাংলায় এসেছিল। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ফিরিঙ্গি বণিকদের আনাগোনা শুরু হয় কলকাতায়। এর পরেই একে একে বিভিন্ন স্থাপত্যশৈলীর প্রভাবে তৈরি হতে থাকে কলকাতার গির্জাগুলি। প্রাচীন এই গির্জাগুলির প্রতিটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অজানা কাহিনি।

আর্মেনিয়ান চার্চ: কলকাতার আর্মেনিয়ান চার্চ, কলকাতায় হাওড়া ব্রিজের সন্নিকটে, বড়বাজারের উত্তর-পশ্চিম কোণে, আর্মেনিয়ান স্ট্রীটে অবস্থিত। ১৭৬৪ সালে নির্মিত ও অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে পরিকল্পিত, কলকাতার আর্মেনিয়ান চার্চ হল বর্তমানে কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন গির্জা। কলকাতার আর্মেনিয়ান চার্চের অভ্যন্তরীণ দেয়ালগুলি মার্বেল দ্বারা সুসজ্জিত এবং গ্যালারির আচ্ছাদনে মূরাল ট্যাবলেট রয়েছে। যীশু খ্রীষ্ট ও তাঁর দ্বাদশ শিষ্যের উদ্দেশ্যে একটি বেদিতে একটি ক্রূশ, খ্রীষ্টের উপদেশাবলী ও ১২-টি মোমবাতি পেশ করা হয়েছে। ইংরেজ চিত্রকার এই হ্যারিসের দ্বারা অঙ্কিত “দ্য হোলি ট্রিনিটি”, “দ্য লাস্ট সাপার” এবং “দ্য এনস্রাউডিং অফ আওয়ার লর্ড”- এই তিনটি তৈল চিত্র, বেদিটির মহিমাকে আরোও বৃ্দ্ধি করেছে। এই গির্জার প্রাঙ্গণে আর্মেনিয়ান কবরস্থানের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।



আর্মেনিয়ানরা প্রাচীণকাল থেকেই ভারতে বসবাস করত। আর্মেনিয়ানরা, ব্রিটিশদেরও আগে ভারতে এসেছিল বলে তারা দাবী করে। তারা ইউরোপীয় মহাদেশে খ্রীষ্টীয়করণেও অগ্রদূত ছিলেন বলে দাবী করা হয়। ১৬৮৮ সালের ২২-শে জুন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইউরোপে আর্মেনিয়ানদের সঙ্গে একটি সমঝোতার স্মারকলিপি বা সন্ধিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুসারে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের যে কোনও জায়গায় গির্জা নির্মাণ করার অনুমিত দেয়, তবে সেখানে কমপক্ষে অন্তত ৪০-জন আর্মেনিয়ানদের বসবাস করতে হবে। পূর্বতন যাজকের পারিশ্রমিক হিসেবে যাজককে ৫০ পাউন্ড দেওয়ার অনুমিত দেয়।

১৬৯০ সলে জব চার্ণক, কলকাতায় তাঁর শেষ দর্শন দেন। তার ১৭ বছর পরে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বর্তমান আর্মেনিয়ান চার্চের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে একটি ছোট কাঠের গির্জা নির্মাণ করেছিলেন। ১৭৩৪ সালে, আগা মামেদ হাজার মালিয়ার দ্বারা কলকাতার এই বর্তমান আর্মেনিয়ান চার্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। গির্জার অভ্যন্তরীণ অলঙ্করণ করেছিলেন কাটচিক্ অরফিয়েল। তিনি যাজকদের বাসস্থানের জন্য আবাস নির্মাণ করেছিলেন এবং কবরস্থানের পাশে উচুঁ প্রাচীর তৈরি করেছিলেন। তিনি অভিজাত গির্জার ঘড়িটির অনুদানী ছিলেন।


পর্তুগিজ চার্চ: সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পর্তুগিজরাও বাণিজ্যিক কারণে কলকাতায় বসতি স্থাপন করেন। জোব চার্নক যখন কলকাতায় এলেন তার আগেই কিন্তু পর্তুগিজরা তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছে। শোনা যায়, জোব চার্নক তাঁদের সাহায্যে এখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সেখানেই খড়ের চালের অস্থায়ী উপাসনালয় তৈরি করেছিল তারা। পরে পর্তুগিজরা সুতানুটি অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হলে, কিছুটা দূরে মুরগিহাটা অঞ্চলে তাদের বসতি এবং উপাসনালয় তৈরি করে।পরে ১৭৯৭-এ তাদের নতুন গির্জার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং ১৭৯৯-এ চার্চটি খুলে দেওয়া হয়। মাঝখানে ত্রিভূজাকৃতি গঠন এবং দু’দিকে দু’টি মিনার বিশিষ্ট এই গির্জাটি কলকাতার গির্জা স্থাপত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



সেন্ট অ্যান’স চার্চ: ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ তৈরির পরে সেখানে প্রার্থনার জন্য ইংরেজরা সেন্ট অ্যান’স চার্চ তৈরি করেছিল ১৭০৯ সালে। সেটি কলকাতার দ্বিতীয় প্রাচীনতম গির্জা, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রথম প্রেসিডেন্সি চার্চ। আজ যেখানে জিপিও, সেখানেই ছিল ইংরেজদের পুরনো কেল্লা। তার মধ্যেই ছিল গির্জাটির অবস্থান। তৎকালীন ইংরেজ ব্যবসায়ীদের চাঁদায় তৈরি হয় গির্জাটি। ১৭৩৭-এ ঘূর্ণিঝড়ে চূড়াটি ভেঙে পড়ে। মুর্শিদাবাদের নবাব আলিবর্দি খাঁ-র মৃত্যুর পরে সিরাজ-উদ্-দৌলা যখন সিংহাসনে বসলেন, ইংরেজরা পুরনো কেল্লা আরও সুরক্ষিত, মজবুত করতে শুরু করলে সিরাজ তাঁদের বারণ করেন। ইংরেজরা সে কথা অগ্রাহ্য করায় ১৭৫৬ সালে সিরাজের কলকাতা আক্রমণ কালে কামানের গোলায় গির্জাটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।

সেন্ট জনস চার্চ: সেন্ট অ্যান’স চার্চ ধ্বংস হওয়ার পরে ইংরেজরা মুরগিহাটায় পর্তুগিজ চার্চে উপাসনা করতে যেত। কিন্তু পর্তুগিজদের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে, ১৭৬০ সালে কেল্লার ফটকের কাছে একটি ঘর তৈরি করে সেটিকেই উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহার করত তারা। ইতিমধ্যে লন্ডনে বোর্ড অফ ডাইরেক্টর্স কলকাতায় বসবাসকারী ইংরেজদের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে নতুন গির্জা তৈরির পরিকল্পনা করে। তারা লালদিঘির কাছে কোম্পানির পুরনো বারুদের গুদামঘরটির জায়গায় গির্জা তৈরির পরিকল্পনা করে। তবে তখন জমিটির মালিক ছিলেন শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব। গির্জা তৈরির কথা রাজাকে জানানো হলে তিনি জমিটি চার্চ কমিটিকে দান করেছিলেন।



ওই গির্জার ঠিক পাশেই ছিল একটি কবরখানা। সেখানেই রয়েছে জোব চার্নকের সমাধি। সেন্ট জনস গির্জা তৈরি হয় বিভিন্ন মানুষের দানে এবং লটারি করে তোলা টাকায়। ১৭৮৪ সালে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। জনশ্রুতি, প্রাচীন গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে মার্বেল পাথর নিয়ে আসা হয়েছিল গির্জায় ব্যবহারের জন্য। গ্রিক স্থাপত্যরীতিতে লন্ডনের সেন্ট স্টিফেন চার্চের আদলে তৈরি এই গির্জাটি ১৭৮৭ সালে উদ্বোধন করা হয়। নামকরণ হয় সেন্ট জনস চার্চ। পাথরের তৈরি বলেই লোকমুখে এর নাম পাথুরে চার্চ।

সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ: কলকাতার স্কটিশ গির্জাগুলির অন্যতম ডালহৌসি অঞ্চলে স্থাপিত সেন্ট অ্যান্ড্রুজ গির্জা। এটি গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত। এখানেই আগে ছিল পুরনো মেয়র্স কোর্ট। এখানে এক বিচারসভায় মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। ১৭৯২ সালে পুরনো আদালতের বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়। তবে পুরনো আদালতের কথা মনে রেখে রাস্তাটির নামকরণ করা হয় ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট। পরে ১৮১৫ সালে এই জায়গাটি স্কটিশদের গির্জা তৈরির জন্য দেওয়া হয়। ১৮১৮ সালে গির্জাটির উদ্বোধন হয়। ১৮৩৫-এ গির্জার টাওয়ারে বসানো হয় একটি মূল্যবান ঘড়ি। গির্জার ভিতরে আজও দেখা যায় কিছু দুর্লভ তৈলচিত্র।



সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল: কলকাতার ক্যাথিড্রাল বলতেই মনে পড়ে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের কথা। ১৮১৯ নাগাদ বিশপ মিডলটনের উদ্যোগে সেন্ট জনস গির্জার পাশাপাশি আরও একটি গির্জা তৈরির পরিকল্পনা এসেছিল খ্রিস্টান সমাজপতিদের মাথায়।
এর পরেই সাহেবপাড়ার কাছাকাছি জমি খোঁজা শুরু হয়। আজ যেখানে ক্যাথিড্রালটি অবস্থিত সেখানে ছিল ঘন জঙ্গল। সেখানেই ১৮৩৯ সালে গির্জাটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ইন্দো-গথিক স্থাপত্যের নিদর্শন এই গির্জাটি তৈরি করতে সময় লাগে আট বছর। ১৮৪৭ সালে তা সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।



সেন্ট জেমস চার্চ (জোড়া গির্জা): ১৮২৬ সালে তৈরি চার্চটি ছিল লেবুতলা লেনে। তবে উইপোকার আক্রমণে গির্জাটির কড়ি-বরগার শোচনীয় অবস্থা হলে সেটি মেরামতির জন্য বন্ধ করে সংস্কারের চেষ্টা হয়েছিল। তবে ১৮৫৮-য় সেটি হঠাৎই ভেঙে পড়ে। এর পরে ওই নামেই একটি গির্জা গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। লোয়ার সার্কুলার রোডে একটি বাড়ি সংলগ্ন বিশাল বাগান কেনা হয় গির্জা তৈরির জন্য। সেখানেই ১৮৬৪ সালে গির্জা তৈরির কাজ শেষ হয়েছিল। পাশাপাশি দু’টি চূড়া থাকার দরুন লোকমুখে প্রচলিত নাম হয় জোড়া গির্জা। পরবর্তী কালে ভক্তদের দানে দেওয়া ঘড়ি ও ঘণ্টা বসেছিল একটি চূড়ায়।



চার্চ অফ আওয়ার লেডি অফ ডলার্স: এটি কলকাতার আরও একটি পর্তুগিজ চার্চ। ১৮০৪-এ পর্তুগিজ ব্যবসায়ী লুই ব্যারেটো বৈঠকখানা বাজার অঞ্চলে একটি চার্চ তৈরিতে উদ্যোগী হলেও তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে কাজ থমকে যায়। পরে ১৮০৯ নাগাদ গ্রেস এলিজাবেথের সাহায্যে আবারও কাজ শুরু হয়। এতে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন ডিয়েগো পেরেরা, ফিলিপ লিল, চার্লস কর্নওয়ালিস প্রমুখ ব্যক্তি। ১৮১০-এ চার্চটি লেডি অফ ডলার্স-এর নামে উৎসর্গ করা হয়। বাইরে যতই শব্দ আর কোলাহল হোক না কেন গির্জার ভিতরটি শব্দ প্রতিরোধক হওয়ায় শান্ত থাকে।



তথ্যসূত্র

বিভিন্ন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম



Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে