ক্লাইভ হাউস - শুভজিৎ দে

বলুনতো, কলকাতায় দোতলা ফুটবল মাঠ কোথায় আছে ? - আচমকাই এমন এক প্রশ্ন আমায় করেছিলেন আমার স্যার । বুঝতে পারিনি, আর বুঝবই বা কি করে তখন খুব ছোটো । পরে জানলাম জায়গাটির নাম ক্লাইভ হাউস । 
ক্লাইভ হাউস

একটু বড় হতে স্যারের সাথে যাওয়া, স্যার আমাদের নিয়ে গেলেন ঢিপির (MOUND) ধারে । বিষয়টি তখন পরিস্কার হয়, আমি নির্বাক । ঢিপির বেশ খানিকটা নীচে ঢিপি লাগোয়া মাঝারি আকারের খেলার মাঠ, স্থানীয় ছেলেরা দল বেঁধে ক্রিকেট খেলছে, একটা বল উড়ে আসে ঢিপির ওপর, বলটা ফিরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখি স্যার হাসছেন, বললেন নীচের মাঠটা দেখলি, এখন পিছন ঘুরে দেখ, তাকিয়ে হতবাক হবার পালা । ঢিপিটা এত বড় ও সুবিস্তৃত খেয়াল করি নি, অল্প গাছপালার আড়ালে আরও একটা খেলার মাঠ, নীচের মাঠটির থেকে এটা আরও অনেক বড়, অকৃত্রিম, বানানো নয়, সবুজ ঘাস । একবার দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যাবে । ডিসেম্বরের নরম রোদ্দুর ঘাসে পড়ে যেন ঠিকরোচ্ছে । দক্ষিন থেকে হালকা ঢাল উত্তরের দিকে । এটাও খেলার মাঠ । দীর্ঘদিন ধরে ফুটবল খেলা হয়, ফুটবল গ্রাউন্ড হিসেবেও বেশ নামডাক আছে । এভাবেই নীচে স্বাভাবিক সমতলে ও সমতল থেকে প্রায় 11 ফুট উঁচুতে অনেকটা off set এর আঙ্গিকে দুটি অকৃত্রিম সবুজ খেলার মাঠ । এমন উদাহরণ কলকাতায় হয়তো দ্বিতীয়টি আর নেই ।

ক্লাইভ হাউস

ঠিকানা - দমদম, নাগেরবাজার 91 রাষ্ট্রগুরু এভিনিউয়ের সুবিখ্যাত 'ক্লাইভ হাউস' চত্বর । নীচের মাঠে খেলা চলছে, আর উপরটি তো বন্ধ । মাঠটিকে সচল ও আধুনিক করার জন্যে কাজ চালাচ্ছে দক্ষিন দমদম পুরসভা, দায়িত্বপ্রাপ্ত দেবজ্যোতি দেবনাথ বাবু বলেন যে, এই মাঠে মাটির নীচ থেকে একজন পুরুষ ও একজন মহিলার বহু পুরনো কঙ্কাল পেয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া । ড্রেজারে কাটা মাটির মধ্যে থেকে উঠে এসেছে ভূগর্ভস্থ আধুনিক ও সাবেকি পাতলা ইঁট, ইঁটের টুকরো আর টালি । কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষন ( A.S.I.) দমদমের এই ঢিপিতে উৎখনন চলায় 2001 এ । উৎখননে উঠে এসেছে প্রায় বাইশশো বছরের সুপ্রাচীন মানব সংস্কৃতির চিহ্ন, A.S.I এর প্রতিবেদনে এই কথাই বলেছেন পুরাতাত্ত্বিকগন । দমদম ঢিপি, দমদমা কোঠি, ক্লাইভ হাউস, সাহেবান বাগিচা ।

লর্ড ক্লাইভ ও ক্লাইভ হাউস

এই এত্ত নামে পরিচিত দমদমের নাগেরবাজার অঞ্চলের এই জায়গাটি, তবে ক্লাইভ হাউস নামেই সমাধিক প্রসিদ্ধ । কৌতূহলী মানুষদের দূর থেকে চোখে পড়বে উপরোক্ত উঁচু ঢিবির ওপর ভাঙাচোরা বাড়ি । ছাদ নেই, দোতলায় মাত্র কয়েকটা দেওয়াল, আবার একতলায় বেশিরভাগ দেওয়ালই ভগ্নপ্রায়, কয়েকটি নিশ্চিহ্ন । একতলারও কোনো ছাদ নেই, শুধু অবয়বটুকু চোখে পড়ে । রাশিকৃত ভাঙাচোড়া জিনিসপত্র পড়ে এখানে সেখানে । ছাদহীন পলেস্তারা খসা সুবিশাল এক ইমারত গুরুত্বপূর্ণ এই সময়কে কোনো ক্রমে আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঔপনিবেশিক স্থাপত্য হিসেবে ইতিহাসের প্রমাণ বহন করছে - এই ইমারতের পাশেই উপরোক্ত দুটি লাগোয়া মাঠ । দ্বিতল মাঠ ব ঢিপির সর্বদক্ষিণে ঢিপির ওপর তৈরী এই কোঠাবাড়ি (ক্লাইভ হাউস) । কোঠাবাড়ি নিয়ে ঢিপির আনুমানিক মাপ যথাক্রমে 200×75×3 ঘনমিটার (প্রায়) । ঐতিহাসিক দমদমা কোঠি বা দমদম হাউস, নিয়ে লেখা-লেখি ও গবেষণা হয়েছে বিস্তর । লেখা চলছে এখনো । গবেষক, ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ববিদ, ভ্রমণাথীর্দের চিরকালীন নজর কেড়েছে এই ক্লাইভ হাউস । এর করণও রয়েছে, প্রথমত 'দমদম', এই স্থানিক বা আঞ্চলিক নামটির সাথে বিজড়িত এ দেশে ঔপনিবেশিক শক্তি প্রদর্শনের দৃপ্ত হুঙ্কার । দ্বিতীয়ত, এর সঙ্গে জড়িয়ে ভারতকে পরাধীন বানানোর 'ব্লু-প্রিন্ট' এর রূপকার রবার্ট ক্লাইভের নাম ।

প্রবেশ পথ

"দমদম" শব্দের উৎস "DUM DUM" থেকে । দমদমা মানে ' A raised mound of BATTERY ' অর্থাৎ গোলাবারুদের জড়ো করা স্তূপ । তথাকথিত অন্যমতে, দমদমা মানে Mound বা ঢিপি, আবার আরবি শব্দ "দমদামাহ"র অর্থ চাঁদমারির জন্য তৈরী উঁচুমৃত্তিকার স্তূপ । কটন সাহেব দমদমা শব্দটি সম্পর্কে বলেছেন, " It is of Persian extraction and means a mound or elevated battery!" গোলাবারুদ থাকা বা না থাকা, নি:সন্ধেহে 'দমদমা' মানে কোনো mound বা ঢিপি, সারা রাজ্যে এমন কত ঢিপির খোঁজ মেলে যার গায়ে লেপ্টে আছে দমদমা শব্দটি । DUMDUMA শব্দটি যে ঢিপি বা স্তূপের সঙ্গে বিজড়িত তার অনবদ্য উদাহরণ এই 'দমদমা হাউস' ।

ভগ্নপ্রায় দেওয়াল

বিহারের মুঙ্গের জেলায় ছোটো একটা পাহাড়ের (স্তূপের) ওপর ইংরেজদের তৈরী 'দমদমা হাউস' নামে একটি বাড়ির কথা জানা যায় । বাড়িটি তৈরী হয়েছিল সম্ভবত সেনাবাহিনীর জন্য । 1891 খ্রিস্টাব্দে Mr. R.C. Sterndale প্রেসিডেন্সি ভলেন্টিয়ার রিজার্ভ বাহিনীর বার্ষিক রিপোর্টে 'দমদমা হাউসের' নাম উল্লেখ করেন । তবে দমদমা হাউস নয়, বরং এই বাড়িটির নিজেস্ব পরিচিতি হল ক্লাইভ হাউস নামে ।

অবশিষ্ট স্তম্ভ

বাড়িটির উত্তরমুখি প্রবেশ পথে এক সময় দেখা যেত সিংহদরজা, যার উপর একটা অস্পষ্ট ফলক তাতে লেখা - "  Countey House of Lord Clive from 1757 to 60 and 65 to 1767. " বাড়িটির আদি মালিকানা বা স্থপতির সুনির্দিষ্ট কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি । কেউ কেউ বলেন এটি ছিল 'ডাচ' বা 'ওলন্দাজদের'একটি তুলার গুদাম । অন্য মতে ওলন্দাজদের তৈরী একটি ছোটো একতলা দূর্গ, যেটি 1757 সালে পলাশির যুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পর তা রবার্ট ক্লাইভের হাতে আসে । ক্লাইভ এটির সংস্কার করান,  বলে জানা যায় । একতলা থেকে এটিকে দুতলায় রূপান্তর করা হয়, এটিই লর্ড ক্লাইভের 'বাগানবাড়ি' । সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ও ক্লাইভের নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী এটির দ্বিতল যুক্ত হয় এই ঔপনিবেশিক স্থাপত্যে । ক্লাইভ হাউস বিষয়ক জাতীয় গ্রন্থাগারের একটি বই থেকে পুরানো ছবির ভিত্তিতে এই ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের নিদর্শন বোঝা যায়, দোতলায় বেশ কয়েকটি স্তম্ভ, সামনে অর্ধগোল, ত্রি-খিলান, গাড়ি বারান্দা বা Portico'র ব্যবহার হয়েছে ।

ভগ্নপ্রায় ক্লাইভ হাউস

কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কলকাতা শাখার ওয়েবসাইটে দমদমের ক্লাইভ হাউস সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে এই কথা বলা আছে - "The monument is situated on a raised ground detached from the surrounding area. The origin of the building is obscure. Perhaps it was a Portuguese or a Dutch factory. According to tradition a treaty between 'Siraj-ud-Daulah' and 'Robert Clive' was signed in this building as a country house is suggested by a marble plaque on the front of the building. The building is fine specimen of colonial architecture."

সংরক্ষণ স্মারকলিপি

তবে ঘটনাটা হচ্ছে, বাড়িটির প্রকৃত মালিকানার ইতিহাস নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে । যেমন এই বাড়িটি ছিল নবাবি আমলে নবাব আলিবর্দি খাঁর 'হন্টিং হাউস' । আলিবর্দি খাঁ ছিলেন আরব দেশীয় মুসলমান । তিনি ভাগ্যান্বেষণে এদেশে এসেছিলেন, এবং পরবর্তী কালে সুবা বাংলার নবাবি তখ্ত লাভ করে এই বাড়িটি তৈরী করেন, কলকাতার কাছাকাছি থেকে ইংরেজদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার উদ্দেশ্যে । পরবর্তীকালে সিরাজ-উদ-দৌলাহ উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক হন, পলাশির যুদ্ধের পর এর মালিকানা বর্তায় ক্লাইভের উপর । ক্লাইভের এই বাড়িটির উল্লেখ বহু জায়গায় পাওয়া যায়, যেমন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক রবার্ট ওর্ম তাঁর History of War in Bengal বইতে লিখেছেন "... leads to dumdum, an old building station on a mound. "  ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় ক্লাইভ শিয়ালদহে নবাবের ক্যাম্প' বা  সৈন্য শিবিরের ওপর সৈন্য চালনা করে দমদম রোড অতিক্রম করেন 1757 সালের 8ই ফেব্রুয়ারির এক ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে ।

ভগ্নপ্রায় ক্লাইভ হাউস

এই রাস্তাতেই ঢিপির ওপর একটি পুরানো বাড়ি, ওর্ম এর বিবরণীতে স্পষ্ট, বাড়িটি নবাবি আমলেই তৈরী হয়েছিল । 1757 সালেই বেশ পুরানো হয়ে পড়েছিল এটি, আবার এটি যে প্রাক ইংরেজ আমলে ওলন্দাজদের কুঠি বা কোঠা বাড়ি ছিল, এমন কথাও চালু আছে । এটি কিছু অংশে সমর্থনযোগ্য এই কারণে যে অদূর পার্শ্ববর্তী বরানগর অঞ্চলে ওলন্দাজ কুঠি বা কোঠা বাড়ি গুলির সঙ্গে এই বাড়িটির স্থাপত্যগত কিছু সাদৃশ্য আছে বলে কোনো কোনো গবেষক বলে থাকেন । বিষয়টি সত্যি হলে আলিবর্দি খাঁ বাড়িটির স্থপতি নাও হতে পারেন, তবে লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে এই বাড়িটির যে একটি সরাসরি সম্পর্ক আছে তার ঐতিহাসিক সমর্থন পাওয়া যায় । তবে এটা নিশ্চিত যে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এখনো পর্যন্ত যে কটি সব থেকে পুরানো বাড়ি রয়েছে, এটি তার মধ্যে অন্যতম, হয়তো বা সব থেকে প্রাচীন । 2004 সালে এই ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক বাড়িটির সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছে কেন্দ্রীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কলকাতা শাখা ।


নিম্নউল্লিখিত তথ্যের স্মারকলিপি

বাড়িটিতে ঢোকার মুখে তাদের লাগানো বোর্ডে এই বাড়ি সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া - " This building known as Clive House or more popularly 'Bere kothi' is known as one of the oldest buildings of Calcutta constructed before the invasion of Calcutta by Siraj-ud-Daulah. Constructed over a mound the graound floor of this strongly built building perhaps served the purpose of a Dutch so Portuguese ware house. After the Battle of Palassey (june 1757) Clive recon structure this adding its upper storcy in colonial style of architecture and used as his Grand House. Subsequently the building changed hands several times and become badly dilapidated. After protection Archaeological Survey of India has undertaken its through restoration ".

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে