তরাইনের যুদ্ধ : ভারতের ইতিহাস পরিবর্তনের ধারা - শুভজিৎ দে
চিত্রসূত্র : ইন্টারনেট
গজনভী সাম্রাজ্য
নবম শতাব্দীর শেষের দিকে তুর্কীরা সুলতান আলপ্তগীনের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে একটি নতুন রাজ্য গঠন করে। পরবর্তীতে ইতিহাসে এই সাম্রাজ্যটি ‘গজনভী’ সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত লাভ করে। ৯৭৭ সালে সুলতান আলপ্তগীন নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার বিশ্বস্ত এবং যোগ্য কৃতদাস সবুক্তগীন ‘গজনভী’ সিংহাসনে আরোহণ করেন। প্রায় ২০ বছর শাসন করার পর ৯৯৭ সালে সবুক্তগীন মৃত্যুবরণ করেন। সবুক্তগীনের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র মাহমুদ গজনীর সিংহাসনে আরোহন করেন। সিংহাসনে বসেই তিনি হিন্দুস্তানের দিকে মনোযোগ দেন। ১০০০ সালের দিকে প্রাথমিক একটি অভিযান পরিচালনা করে তিনি হিন্দুস্তান সীমান্তের বেশ কয়েকটি প্রতিরক্ষা দুর্গ দখল করে নেন। এরপর ১০০১ থেকে ১০২৬ সালের মাঝে গজনীর সুলতান মাহমুদ মোট ১৭ বার হিন্দুস্তানে আক্রমণ পরিচালনা করেন। তাঁর এতবার আক্রমণের পেছনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণ ছিলো। কোনো আক্রমণের কারণ ছিলো রাজনৈতিক আবার কোনোটি ধর্মীয় কারণে হয়েছিলো। হিন্দুস্তানের রাজারা অনেক সময় সুলতানের সাথে পূর্বের করা চুক্তির বরখেলাপ করতেন, কখনো সুলতানের হিন্দুস্তানীয় মিত্রদের আক্রমণ করতেন। এসব কারণে সুলতান মাহমুদকে বারবার হিন্দুস্তানে অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছিলো। তবে সুলতান মাহমুদের আক্রমণ হিন্দুস্তানে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘস্থায়ী কোনো ফল বয়ে আনে নি। তিনি শুধুমাত্র পাঞ্জাবকে তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। গজনীর সুলতান মাহমুদ ৯৯৭ সাল থেকে ১০৩০ সাল পর্যন্ত মোট ৩৩ বছর শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে তিনি ইরানের পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূমি নিজের অধীনে আনতে সক্ষম হন। এছাড়া হিন্দুস্তানের উত্তর-পশ্চিম অংশে তাঁর নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিলো। বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তান আর ইরানের পূর্বাঞ্চল সহ বিশাল এক ভূ-খন্ড শাসন করতেন তিনি। তবে শক্তি আর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন হিন্দুস্তানের ভূ-খন্ডকে নিজের সরাসরি শাসনাধীনে নেন নি, এটা একটা বিস্ময় বৈকি!
সুলতান মাহমুদ মৃত্যুবরণ করেন ১০৩০ সালের ৩০ এপ্রিল। তাঁর মৃত্যুর পর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে রাজ পরিবারের মাঝেই বিরোধ লেগে যায়। অন্যদিকে, মধ্য আর পশ্চিম এশিয়ার সেলজুক আক্রমণের ভয়ে সাম্রাজ্যের রাজধানী দ্রুত পাঞ্জাবের লাহোরে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয় নি। গজনী রাজ্যেরই কিছু সামন্ত রাজা জোটবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ করেন। তাদের নেতৃত্ব দেন ঘুরি সাম্রাজ্যের সুলতান গিয়াস উদ্দীন মুহাম্মদ। ১১৭৩ সালে তিনি গজনভী সাম্রাজ্যের পুরাতন রাজধানী গজনী দখল করে নিতে সক্ষম হন। ১১৮৬ সালে পাঞ্জাবের লাহোর দখল করে নিলে গজনী সালতানাতের চূড়ান্ত পতন ঘটে।
ঘুরি সাম্রাজ্য
ঘুরি রাজবংশ মূলত পূর্ব ইরানের একটি সুন্নী মুসলিম রাজবংশের নাম। তাজিক বংশোদ্ভূত এই রাজপরিবারটি ৮৯৭ সাল থেকে শুরু করে ১২১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভূ-খন্ড শাসন করে। তবে ঘুরি সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো বর্তমান আফগানিস্তানের ঘুর প্রদেশটি। এই প্রদেশটি ‘মান্দেশ’ নামেও পরিচিত। বর্তমান ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান আর ইরানের পূর্বাঞ্চল জুড়ে বিস্তীর্ন ভূ-খন্ড এই রাজবংশের শাসনাধীনে ছিলো।
১০৬৩ সাল থেকে ১২০২ সাল পর্যন্ত ঘুরি সাম্রাজ্যেরসুলতান পদে আসীন ছিলেন গিয়াসউদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরি। গিয়াসউদ্দীন মুহাম্মদের পর ঘুরি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন তাঁর ছোট ভাই মুইজউদ্দিন মুহম্মদ শিহাবুদ্দীন ঘুরি। এই মুইজউদ্দিন মুহম্মদই হিন্দুস্তানের ইতিহাসে ‘মুহাম্মদ ঘুরি’ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরি তাঁর ভাই গিয়াসউদ্দীন মুহাম্মদকে সাম্রাজ্য বিস্তারে ব্যাপক সহায়তা করেন। তবে তিনি হিন্দুস্তানের দিকে সবসমই তীক্ষ্ম নজর রাখতেন। ফলশ্রুতিতে, ১১৭৫-৭৬ সালে মুলতান তাঁর অধিকারে আসে। এরপর একে একে উচ, গুজরাট, পেশওয়ার আর শিয়ালকোট তাঁর পদানত হয়। তবে ১১৭৮ সালে কায়াদারার যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন।
তরাইনের প্রথম যুদ্ধ
বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের কনৌজের রাজা ছিলেন রাজপুত বংশোদ্ভুত জয়চন্দ্র। রাজা জয়চন্দ্রের কন্যা সংযুক্তাকে পছন্দ করতেন আরেক রাজপুত রাজা বীর পৃথ্বীরাজ চৌহান। পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু রাজা জয়চন্দ্র এই প্রস্তাব মেনে নিলেন না। পৃথ্বীরাজ পরবর্তীতে সংযুক্তাকে অপহরণ করে নিয়ে যান। কথিত আছে, তাদের ভেতরে পত্রযোগে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। নিজের মেয়ে অপহরণের পর রাজা জয়চন্দ্র প্রায় এক বছর কূটনৈতিকভাবে প্রচেষ্টা চালালেন মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু কোনোভাবেই সফল হলেন না। পৃথ্বীরাজের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ক্ষুব্ধ রাজা জয়চন্দ্র মুহাম্মদ ঘুরিকে আমন্ত্রণ জানালেন হিন্দুস্তান আক্রমণ করতে!
যে শাসকের এক চোখ সবসময় হিন্দুস্তানের উপরে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো, সে শাসক হিন্দুস্তানের এই অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগ নিবেন না কেন? আর তাই রাজা জয়চন্দ্রের আমন্ত্রণ পেয়ে, ১১৯১ সালে শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরি আর দেরি না করে হিন্দুস্তানের দিকে রওয়ানা দেন। খাইবার গিরিপথের মাঝখান দিয়ে দ্রুতগতিতে তিনি পাঞ্জাবে এসে পৌঁছান। পাঞ্জাবের বাথিন্ডায় পৃথ্বীরাজের একটি দুর্গ ছিলো। মুহাম্মদ ঘুরি বাথিন্ডার এই দুর্গটি দখল করে নেন।
এদিকে পৃথ্বীরাজ চৌহানের কানে মুহাম্মদ ঘুরির হিন্দুস্তান অভিমুখী অগ্রযাত্রার খবর পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগলো না। পৃথ্বীরাজ মুহাম্মদ ঘুরির উদ্দেশ্য খুব সহজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। আর তাই মুহাম্মদ ঘুরির অগ্রযাত্রার খবর পেয়ে তিনি তাঁর শশুর রাজা জয়চন্দ্রের কাছে সাহায্য চান। কিন্তু মেয়ের অপহরণকারীকে রাজা জয়চন্দ্র কেন সাহায্য করবেন? পৃথ্বীরাজ চৌহান ব্যর্থ হলেন। উপায় না পেয়ে পৃথ্বীরাজ তাঁর ভাইপো গোবিন্দ তাইকে নিয়ে মুহাম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীর উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর সাথে ২০ হাজার অশ্বারোহী সহ প্রায় ৫০ হাজারের বিশাল এক সেনাবাহিনী। মুহাম্মদ ঘুরির সাথে পৃথ্বীরাজ চৌহানের দেখা হলো হরিয়ানার থানেশ্বরের তরাইন গ্রামে। মুহাম্মদ ঘুরির কাছে অশ্বারোহী আর পদাতিক মিলে প্রায় ৩৫ হাজার সৈন্য আছে। পৃথ্বীরাজ চৌহান বিজয়ের ব্যাপারে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে উঠলেন।
তরাইনের প্রান্তরে দুটি সেনাবাহিনী পরস্পরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুটি সেনাবাহিনীরই উদ্দেশ্য পৃথিবীর বুক থেকে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। জেনারেলরা অনাগত যুদ্ধের জন্য শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রচলিত যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রত্যেক বাহিনীই নিজেদের বাহিনীকে ডানবাহু, বামবাহু ও মধ্যবাহুতে বিভক্ত করে। অবশেষে সেই মুহূর্তটি এলো। যুদ্ধ হলো শুরু!
আসলে যুদ্ধে জয়-পরাজয় নিশ্চিত হয় যুদ্ধ শুরুর আগেই। মুহাম্মদ ঘুরি প্রকৃতপক্ষে এই যুদ্ধ শুরুর আগেই পরাজিত হয়ে বসে ছিলেন। কারণ, তিনি তাঁর বাহিনীকে রাজপুতদের সাথে সামনাসামনি লড়াই করার জন্য নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। বাহিনীর বিন্যাসও ছিলো সেরকমই। অথচ, তাঁর বাহিনীর বেশিরভাগ যোদ্ধাই ছিলেন তুর্কী। এসব যোদ্ধারা সম্মুখ লড়াইয়ের পরিবর্তে তুর্কী বিশেষ কৌশলে যুদ্ধ করতেই অভ্যস্ত ছিলেন। প্রতিপক্ষের তীব্র আক্রমণের সময় তুর্কী যোদ্ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে যাওয়ার ভান ধরতেন। প্রতিপক্ষ পলায়নপর যোদ্ধাদের তাড়া করতেন। ঠিক এই সময়টির জন্য তুর্কী যোদ্ধারা অপেক্ষা করতেন। তারা পলায়নপর ঘোড়ার পিঠ থেকে উল্টো হয়ে প্রতিপক্ষের দিকে তীর ছুঁড়তেন। তুর্কী যোদ্ধাদের এই কৌশলটি পরীক্ষিত। তাঁদের এই কৌশলটি খুব কমই ব্যর্থ হতো।
আর মুহাম্মদ ঘুরি ঠিক এই জায়গাটিতেই ভুল করেছিলেন। তিনি তুর্কী সৈন্যদের তাঁদের নিজস্ব রীতিতে লড়াই করতে না দিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে তাঁদের লড়াই করতে পাঠান। ফলে এই অনভ্যস্ত রীতিতে ঘুরি সেনাবাহিনীর তুর্কী যোদ্ধারা খুব সহজের কাবু হয়ে যান। রাজপুতদের তীব্র তীরবৃষ্টি আর সম্মুখ আক্রমণে ঘুরির বাহিনী খুব সহজেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মুহাম্মদ ঘুরি নিজেও যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হন।
তরাইনের এই যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘুরির বেশিরভাগ সৈন্যই নিহত হন। যারা জীবিত ছিলেন তাঁদের অবস্থাও বেশ নাজুক ছিলো। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে কোনোমতে তারা আফগানিস্থান ফিরে যান।
পৃথ্বীরাজ চৌহানের গৌরবদীপ্ত বিজয় আর মুহাম্মদ ঘুরির শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমেই শেষ হয় তরাইনের প্রথম যুদ্ধটি। পৃথ্বীরাজ চৌহান তাঁর নিজ দেশে পান বীরের মর্যাদা।
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের বীজ লুকিয়ে ছিলো তরাইনের প্রথম যুদ্ধেই। ১১৯১ সালের তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাছে মুহাম্মদ ঘুরি লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে তিনি এতটাই অপমানিত বোধ করছিলেন যে, কথিত আছে, তিনি নাকি খাবার-দাবার প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। এমনকি নিজের পরিবারের সাথেও দেখা করতেন না। এই এক বছর তিনি তাঁর সেনাবাহিনী পুনর্গঠন আর যুদ্ধ পরিকল্পনা করতে ব্যয় করেন।
তরাইনের প্রথম যুদ্ধের পরের বছর, অর্থাৎ, ১১৯২ সালে দ্বিতীয়বারের মতো পৃথ্বীরাজ চৌহানের মোকাবেলা করতে এগিয়ে আসেন মুহাম্মদ ঘুরি। ঐতিহাসিক আবু ওসমান মিনহাজ উদ্দীন বিন সিরাজুদ্দীনের (মিনহাজ-ই-সিরাজ) লেখা থেকে পাওয়া যায়, এ সময় মুহাম্মদ ঘুরির সাথে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের বিশাল এক সেনাবাহিনী ছিলো। এই বিশাল বাহিনীতে অশ্বারোহী সেনা ছিলো প্রায় ৫২ হাজার।
মুহাম্মদ ঘুরির অগ্রযাত্রার খবর পেয়ে পৃথ্বীরাজ চৌহানও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পারেন এবারের যুদ্ধটি আগের যুদ্ধ থেকেও তীব্র হবে। তাই নিজের শক্তি বৃদ্ধির জন্য তিনি অন্যান্য রাজপুত রাজা আর অভিজাত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে সাহায্য চান। পৃথ্বীরাজের সহায়তায় প্রায় ১৫০ জন রাজপুত রাজা এগিয়ে আসেন। আশেপাশের রাজ্যের সাহায্য পেয়ে পৃথ্বীরাজ বিশাল এক সেনাবাহিনী গঠন করতে সক্ষম হন। ঐতিহাসিক ফারিস্তার বর্ণনায় জানা যায়, পৃথ্বীরাজের বাহিনীতে হাতিই ছিলো প্রায় ৩,০০০ এর বেশি। আর অশ্বারোহীসহ সেনাবাহিনীর আকার দাঁড়ায় ৩ লাখে!
পৃথ্বীরাজ চৌহান এবং মুহাম্মদ ঘুরী পুনরায় তরাইনের উন্মুক্ত প্রান্তরে মুখোমুখি হন। মুহাম্মদ ঘুরি তাঁর বাহিনীকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেন- অগ্রবর্তী বাহিনী, মধ্য বাহিনী, ডান বাহু, বাম বাহু আর পশ্চাৎ বাহিনী। প্রতিটি অংশে সৈন্যসংখ্যা ছিলো ১০ হাজার করে। মুহাম্মদ ঘুরি তাঁর নিজের কমান্ডে প্রায় ১২ হাজার সৈন্য রিজার্ভ হিসেবে রাখেন। অন্যদিকে রাজপুত সেনাবাহিনী প্রচলিত ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী নিজেদের মতো করে সেনাবিন্যাস করে।
পূর্বের যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ায় রাজপুতরা আগের তুলনায় বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলো। তাছাড়া, এই যুদ্ধে রাজপুত বাহিনীর আকার ঘুরি বাহিনীর তুলনায় দ্বিগুনের বেশি ছিলো। অন্যদিকে পূর্বের পরাজয়ের তিক্ততা মুহাম্মদ ঘুরি তখনও ভুলতে পারেন নি। এ যুদ্ধে তাকে যেভাবেই হোক, বিজয় অর্জন করতে হবে।
যুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে উভয় পক্ষই প্রথমে কূটনৈতিক আলোচনার চেষ্টা করে। রাজপুতরা আসলে আরো কিছুটা সময় আদায় করতে চাইছিলো। রাজপুত উদয়রাজ তখনো যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পৌঁছাতে পারেন নি। অন্যদিকে মুহাম্মদ ঘুরি নিজেকে কিছুটা দুর্বল হিসেবে প্রকাশ করতে চাইলেন, যাতে রাজপুতরা আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। মুহাম্মদ ঘুরি এক্ষেত্রে বেশ সফল হয়েছিলেন, কারণ রাজপুত বাহিনীর ভেতরে বেশ ঢিলেঢালা ভাব এসে পরেছিলো।
মুহাম্মদ ঘুরি এই মুহূর্তটির অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি ভোরের দিকে রাজপুত শিবিরে আক্রমণ চালালেন। রাজপুত সেনারা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো। তাদের ঘুম ভাঙ্গে মুহাম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর। চারপাশ থেকে রাজপুত সেনাবাহিনীকে ঘিরে তীর বৃষ্টি হচ্ছিলো। তবে রাজপুত সেনাবাহিনীর আকার ছিলো আক্ষরিক অর্থেই বিশাল। আর আকারের এই বিশালতার কারণে খুব সহজেই রাজপুত সেনারা নিজেদের সামলে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজপুতরা ছিলেন সহজাত যোদ্ধা জাতি। যুদ্ধক্ষেত্রে পিঠ দেখানোর কথা তাদের ব্যাপারে খুব কমই শোনা যেত। হয় তারা যুদ্ধে জিততেন, নয়তো যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করতেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বাঁচার চেয়ে যুদ্ধে মারা যাওয়াকেই রাজপুতরা বেশি সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। দ্রুতই রাজপুত সেনাবাহিনী মুহাম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীকে তীব্র বাঁধা প্রদান করেন।
তরাইনের প্রথম যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘুরি যে ভুলটি করেছিলেন, তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তিনি আর তার পুনরাবৃত্তি করলেন না। তিনি তার সেনাবাহিনীর তুর্কী ইউনিটটিকে তাঁদের নিজস্ব রীতিতে যুদ্ধ করতে দেন। তুর্কী যোদ্ধারাও নিজেদের চিরাচরিত পদ্ধতিতে লড়াই করার সুযোগ পেয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন। রাজপুত সেনাবাহিনীর বাঁধার মুখে তুর্কী অশ্বারোহীরা হঠাতই পিছু হটতে থাকেন। এতে রাজপুত সেনারা প্রবল আত্মবিশ্বাসী হয়ে তুর্কী অশ্বারোহীদের ধাওয়া করতে গেলে হঠাতই তুর্কীরা ঘুরে রাজপুতদের উপর বৃষ্টির মতো তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। হিন্দুস্তানের রাজপুত সেনাবাহিনী এই কৌশলের সাথে পরিচিত ছিলো না। তারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। প্রায় ৩ ঘন্টার মতো রাজপুত বাহিনীর উপর তীর নিক্ষেপ হতে থাকে। অসহায়ের মত দেখা ছাড়া তাঁদের আর করার মতো তেমন কিছু ছিলো না। একপর্যায়ে রাজপুত সেনারা তাঁদের মনোবল হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া তাঁদের শারিরীক সামর্থ্যও সহ্যের শেষ সীমায় চলে যায়।
তবে শুধু তুর্কী কৌশলই শেষ না, মুহাম্মদ ঘুরির আরো চমক দেখানো বাকী ছিলো। তিনি এবার তাঁর রিজার্ভ সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করেন। একে তো তীব্র আতঙ্কে রাজপুত সেনারা যুদ্ধ করার ইচ্ছাই হারিয়ে ফেলেছে, তার উপর পরিশ্রান্ত রাজপুত সেনাদের উপরে আক্রমণ চালায় সম্পূর্ণ সতেজ রিজার্ভ সৈন্যরা। রাজপুত সেনাবাহিনী এবার আর যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারলো না। রাজপুত বাহিনীর শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙ্গে যায়। ইতোমধ্যেই পৃথ্বীরাজ চৌহানের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনাপতি খান্ডে রাও নিহত হন, যা রাজপুত বাহিনীর চূড়ান্ত পতন তরান্বিত করে। রাজপুত সেনারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ব্যাপকহারে পলায়ন শুরু করে। এই যুদ্ধেরই কোনো পর্যায়ে রাজপুত বীর রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান মৃত্যুবরণ করেন।
পৃথ্বীরাজ চৌহান (১১৪৯–১১৯২ খ্রি.) ছিলেন রাজপুত চৌহান রাজবংশের একজন রাজা। ১১৭৯ সালে যখন তিনি সিংহাসনে আরোহন করেন, তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ১৩ বছর। তিনি উত্তর ভারতের আজমীর আর দিল্লী শাসন করতেন। তরাইনের এই দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয়ের সাথে সাথে হিন্দুস্তান থেকে শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজ্যটিরও পতন ঘটে। আর ঠিক এই কারণেই, হিন্দুস্তানের ইতিহাসে হিন্দুদের কাছে বীর পৃথ্বীরাজ চৌহানের গুরুত্ব অনেক বেশি। পৃথ্বীরাজ চৌহানই ছিলেন হিন্দুস্তানের শেষ স্বাধীন রাজা যিনি বিক্রমাদিত্য হিমুর পূর্বে দিল্লীর সিংহাসন দখলে রাখতে পেরেছিলেন। হিন্দুস্তানের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা আজও পৃথ্বীরাজ চৌহানকে বীরের মর্যাদা দেন, যিনি একটি স্বাধীন হিন্দু রাজ্যের জন্য নিজের জীবন দান করেছিলেন।
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ পরবর্তী হিন্দুস্তানের অবস্থা
তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘুরি হিন্দুস্থানের উপর চূড়ান্ত রকমের বিজয় অর্জন করেন। বিজয়ের পর তিনি তার বিশ্বস্ত সেনাপতি কুতুবুদ্দীন মুহাম্মদ আইবেককে দিল্লী দখল ও হিন্দুস্থানের বিজিত ভূ-খন্ডের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে রাজধানী ফিরে যান। এবার সতর্ক হয়ে উঠেন পৃথ্বীরাজের শ্বশুর রাজা জয়চন্দ্র! তিনি ভেবেছিলেন মুহাম্মদ ঘুরি তার আগের যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়ে আর ধনসম্পদ অর্জন করে নিজ দেশে দিরে যাবেন। কিন্তু মুহাম্মদ ঘুরির ইচ্ছা তো আর রাজা জয়চন্দ্র জানতেন না! মুহাম্মদ ঘুরি আসলে হিন্দুস্থানে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন।
রাজা জয়চন্দ্র মুহাম্মদ ঘোরীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। ফলে বাধ্য হয়ে মুহাম্মদ ঘুরি আবারো হিন্দুস্তান অভিমুখে ধেয়ে আসেন। বর্তমান ফিরোজাবাদের চন্দ্রবারে মুহাম্মদ ঘুরি আর রাজা জয়চন্দ্র পরস্পরের মুখোমুখি হন। যুদ্ধে রাজা জয়চন্দ্র প্রথমে চোখে তীরবিদ্ধ হয়ে হাতির পিঠ থেকে পড়ে যান। পরে হাতির পায়ের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেন।
মুহাম্মদ ঘুরি হিন্দুস্তানের উপর চূড়ান্ত রকমের আধিপত্য কায়েম করেও হিন্দুদের প্রতি উদার নীতি গ্রহণ করেন। পূর্বের মতোই অনেক হিন্দু রাজা তাঁদের নিজস্ব রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। প্রশাসনের উঁচু পদে হিন্দুদের স্থান দেয়া হয়। হিন্দুস্থানের অধিবাসীদের নিজ নিজ ধর্ম পালনে কোন প্রকার বাঁধা দেয়া হতো না। এমনকি মুহাম্মদ ঘুরির হিন্দুস্তান বিজয়ের পূর্বে হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর প্রতিকৃতি সহ যে মুদ্রা প্রচলিত ছিলো, সেগুলোরও কোন পরিবর্তন করা হয় নি।
মুহাম্মদ ঘুরির মৃত্যু
শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরির মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, তা নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি আছে। বেশ কিছু মতবাদ অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রে পৃথ্বীরাজ মৃত্যুবরণ করেন নি। বরং তিনি বন্দী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে বন্দীদশায় সুযোগ পেয়ে মুহাম্মদ ঘুরিকে তিনি হত্যা করেন। মুহাম্মদ ঘুরির মৃত্যুসংক্রান্ত এই মতবাদটি একটু বেশিই কল্পনাপ্রবণ। কিছু কিছু সূত্র অনুযায়ী, মুহাম্মদ ঘুরিকে হত্যা করে হিন্দু গাক্কাররা। আবার কোন সূত্র মুহাম্মদ ঘুরির হত্যাকারী হিসেবে হিন্দু খোকারদের দায়ী হিসেবে দাবী করে। মুহাম্মদ ঘুরির সমসাময়িককালে এই হিন্দু খোকাররা পাঞ্জাবে প্রচুর হত্যা, লুন্ঠন আর নির্যাতন চালাতো। আর তাই ঘুরি এই খোকার উপজাতিকে নির্মমভাবে দমন করেন। ঐতিহাসিক নিজামী আর ফারিস্তার মতে, ১২০৬ সালে পাঞ্জাবের ঝিলাম নদীর তীরে সল্ট রেঞ্জের তীরে গাক্কাররা মুহাম্মদ ঘুরিকে হত্যা করে। তবে তাঁদের পূর্ববর্তী সূত্রগুলো গাক্কারদের নয় বরং খোকারদেরই দায়ী করছে। ফারিস্তার পূর্ববর্তী ঐতিহাসিকদের মত হচ্ছে, ১২০৬ সালের ১৫ মার্চ মাগরিবের নামাজ আদায়রত অবস্থায় খোকাররা হিন্দুস্তানে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকারী শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরিকে হত্যা করে এবং এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত।
সুলতান মুইজউদ্দিন মুহম্মদ শিহাবুদ্দীন ঘুরির পুরো জীবনটিই বলতে গেলে যুদ্ধময়। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিলো হিন্দুস্তানের বিস্তীর্ন ভূ-খন্ডে মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আর এই জায়গা থেকে তিনি সম্পূর্ণ সফল শাসক ছিলেন। হিন্দুস্তানে তাঁর অভিযানগুলোর পথ ধরেই প্রতিষ্ঠা পায় হিন্দুস্তানের দিল্লী সালতানাত। ইসলামের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ মেলে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের। ইতিহাসের এক নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, বিজয়ী শক্তি সবসময়ই বিজিত জাতিগুলোর উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতো, নানা ভাবে অত্যাচার আর নির্যাতন করে তাদের জীবন বিষিয়ে তুলতো। কিন্তু মুসলিম শক্তিগুলো সেসবের ধারেকাছে দিয়েও গেল না। বরং তাঁরা বিজিত অঞ্চলের মানুষের মন জয়ের চেষ্টা করলেন। ফলাফল হলো, বিজিত অঞ্চলের মানুষরা ইসলামকে মন থেকে স্বাগতম জানাতো। এই দিল্লী সালতানাতের হাত ধরেই পরবর্তীতে হিন্দুস্তানে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করে পরাশক্তি মুঘল সাম্রাজ্য। আরব বণিকদের হাত ধরে ইসলামের যে জয়যাত্রা হিন্দুস্তানে শুরু হয়, তা পূর্ণতা লাভ করে মুঘল সাম্রাজ্যের হাত ধরে। হিন্দুস্তানের ভূ-খন্ডের ধরনই একটু আলাদা। এই মাটি সবসময়ই নতুন সাম্রাজ্যের নতুন কোনো শাসককে গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে!
তথ্যসূত্র:
১। বিশ্বসভ্যতা (মধ্যযুগ)- এ. কে. এম. শাহনাওয়াজ
২। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান
৩। ইতিহাসের ইতিহাস- গোলাম আহমেদ মোর্তজা
৪। ভারতবর্ষের ইতিহাস- কোকা আন্তোনোভা, গ্রিগোরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারলাম। ধন্যবাদ
ReplyDelete