উপনিবেশবাদ বিরোধী অগ্নিযুগের প্রারম্ভিক পর্বের অন্ধকারে নিমজ্জিত মহিলা বিপ্লবী - শুভজিৎ দে

ননীবালা দেবী এবং দুকড়িবালা দেবী

অগ্নীযুগের প্রথম মহিলা বিপ্লবী শহিদ হিসেবে প্রথম যে নামটি সবাই বলে, সে হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার । কিন্তু বলে রাখা প্রয়োজন যে অগ্নিযুগের প্রারম্ভিক পর্বের বিপ্লবী প্রীতিলতা নন, তিনি যাঁদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বাধীনতা অন্দোলোনে আসেন তাঁরা আজ সমাজের চোখে হারিয়ে গেছেন, রযেগেছেন অপাঙ্ক্তেয় হিসেবে । আসলে সব সময়ই কিছু মানুষ অন্ধকারে থেকে যান, ঠিক যেমনটি প্রদ্বীপ সমস্ত ঘরকে আলোকিত করলেও, সেই প্রদ্বীপ তার নিচে হওয়া অন্ধকারকে আলোর মুখ দেখাতে পারে না । বিপ্লব বা সশস্ত বিপ্লব অনেক দিন আগে শুরু হলেও সেই পর্বে কেউ মারা গেলেও আমরা সেইসব নিয়ে ভাবি না, কারণ আমাদের প্রয়োজন হয় একটি মাইলফলকের বা আমরাই তাকে মাইলফলক তৈরী করি । এবং সেটাই আমরা বয়ে নিয়েযাই ঐতিহ্য ও ইতিহাস রূপে । সেই মাইলফলকের আগে থাকা সংখ্যা বা দুরত্বের যেমন কোনো গুরুত্ব থাকে না, ঠিক তেমনই প্রীতিলতার আলোর তেজে অন্ধকারে হারিয়েগেছেন এনারা । এমনই দুজন হলেন ননীবালা দেবী ও দুকড়িবালা দেবী । যাঁরা এই অগ্নিযুগের প্রারম্ভিক পর্বের মহিলা বিপ্লবী । এখানে তাঁদের সম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়া চেষ্টা করছি ।


ননীবালা  দেবী   
         
             বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী ছিলেন ননীবালা দেবী। তিনি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার অন্তর্গত বালির এক সাধারন ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে! 1899 সালে মাত্র 11 বছর বয়সে তার বিয়ে  হয়েছিল,আর বিয়ের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় 1904 সালে স্বামী মারা গেলেন। ননীবালা দেবীর বয়স তখন মাত্র 16 বছর। সেসময় ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবাদের জীবন ছিল এক দুঃখের আবরণে মোড়া। সংসারের এক কোনায় জীবন্মৃতের মত বেঁচে থাকাই ছিল তাদের জীবন। বিনা মাইনে তে শ্বশুর বাড়ি কিংবা বাপের বাড়িতে খেটে খেটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেঁচে থাকাই ছিল যাদের জীবন!
              ননীবালা সে সব কথা মেনে জীবন কাটাতে রাজি হলেন না, কারণ স্বদেশীদের নানা খবর তিনি রাখতেন ও তিনি সামান্য লেখাপড়াও জানতেন।
সেসময় ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুবক বৃদ্ধ সকলেই প্রাণ দিতে প্রস্তুত। যে যেভাবে পারছে সাহায্য করছে বিপ্লবীদের। সে সময় সদ্য দেশের ডাকে শহীদ হয়েছেন কিশোর ক্ষুদিরাম।এমতাবস্থায় ননীবালা স্বাধীনতার যুদ্ধে যোগ দিতে প্রস্তুত হলেন। তাঁর ভাইপো অমরেন্দ্র চ্যাটার্জী ছিলেন বিপ্লবী চরমপন্থী যুগান্তর পার্টির নেতা।তিনি বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন ননীবালাকে। শুরু হলো জীবনের এক নতুন অধ্যায়। কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠলেন বিপ্লবী সমিতির এক নির্ভরযোগ্য সক্রিয় সহযোগী। দেশকে ভালোবেসে বিপ্লবীদের হয়ে তিনি নানান ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিলেন। এমন দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো সম্পন্ন করা আরম্ভ করলেন যে কাছের মানুষও টের পেত না যে তিনি বিপ্লবী দলের সক্রিয় সদস্য। তিনি বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতেন, নেতাদের নির্দেশ ও অন্যান্য দরকারী খবর বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্র গোপনে বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন, এমনকি জেলে বন্দী কর্মীদের সঙ্গে বাড়ির লোক সেজে, দেখা করে, খবর সংগ্রহ করার কাজও তিনি করতেন।
সারাদিন তকলিতে সুতো কাটতেন,আর সুতো পৌঁছে দিতেন যারা পৈতা বানাতো তাদের কাছে। যা ছিলো তখনকার সাধারণ বাঙালি ঘরের আর পাঁচটা ভালো বিধবার জীবিকা। অন্ধকার নামলেই – মানুষের চোখ এড়িয়ে পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে তিনি দেশের কাজে বের হতেন। তাঁর সাধারণ জীবন যাপন দেখে কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারত না বিপ্লবী বলে।
                     1915 সালে ঘটে এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভারত-জার্মান অস্ত্র ষড়যন্ত্রের ঘটনা। সময় 10ই সেপ্টেম্বর যুগান্তর পার্টি প্রধান বিপ্লবী বাঘা যতীন “কোপতিপোতায়” পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হয়ে বালাসোর হাসপাতালে মারা যান। কলকাতাতে পুলিশি ধরপাকড়ের সময় শ্রীঅমরেন্দ্র চ্যাটার্জী পালিয়ে গেছেন, ধরা পড়েছেন বিপ্লবী শ্রীরামচন্দ্র মজুমদার। তাঁর হাতে একটি মাউজার পিস্তল এসেছিল কিন্তু তিনি সেটি কোথায় লুকিয়ে ছিলেন কেউ তা জানতো না। অথচ বিপ্লবীদের সেটির দরকার ছিল, কিন্তু কিভাবে তার সন্ধান জানা যাবে?
               অতএব জেলে ঢুকে রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে পিস্তলের খোঁজ আনতে চললেন দুঃসাহসী ননীবালা। সেদিনের সমাজে যা কেউ কল্পনা করতেও পারতো না।  বিধবা ননীবালা সেজে একগলা ঘোমটা দিয়ে রামচন্দ্রের স্ত্রী সেজে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন জেলে। পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে, পিস্তল এর সন্ধান জেনে বেরিয়ে এলেন প্রেসিডেন্সি জেল থেকে। এরপর পুলিশের টিকটিকি লাগলো তার পিছনে।
            বাসা বদল করতে হলো তাকে। রিষড়া থেকে তিনি চলে এলেন চন্দননগরে। বিপ্লবী ভোলানাথ চ্যাটার্জী সেখানে বেনামে বাড়ি ভাড়া করে রাখলেন  ননীবালাকে আর নিজের পিসীমাকে। এই বাড়ি গুলোতে অনেক দিন নিরাপদে থেকে গেছেন বিপ্লবী ভোলানাথ চ্যাটার্জী, জাদু গোপাল মুখোপাধ্যায়,বিনয় ভূষণ দত্ত, নলিনীকান্ত কর, অতুল ঘোষ প্রমুখ বাঘা বাঘা বিপ্লবীরা। যাঁদের নামে অনেক টাকার হুলিয়া জারি করেছিল পুলিশ। এঁদের কাছ থেকে খবর বা অস্ত্র সংগ্রহ করে বাইরের বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন, আর বাইরে থেকে কিছু জোগাড় করতে হলে সেগুলি জোগাড় করে এনে এঁদেরকে পৌঁছে দিতেন বিপ্লবী ননীবালা।রাতের  অন্ধকারে নিশাচরের মতো হাজির হতেন। পুলিশের গন্ধ পেলেই অদৃশ্য হয়ে যেতেন।
           এমন সময়1916 সালে পুলিশের নজর পড়লো বাড়ির কর্ত্রী বিশেষতঃ ননীবালার ওপর। তাদের সব কাজের খবরই পেল পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তার করতে আসার খবর পেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন দুঃসাহসী ননীবালা। পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে পালিয়ে গেলেন কলকাতা ছেড়ে, অবশেষে তার খোঁজ মিলল পেশোয়ারে। গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তিনি কলেরায় আক্রান্ত ছিলেন। অসুস্থ শয্যাশায়ী ননীবালা গ্রেপ্তার হলেন বেআইনি অস্ত্র রাখা,বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়া এই সব অভিযোগে।
             তাঁকে এনে রাখা হলো কাশীর জেলে। নানা ভাবে অত্যাচার করেও বিপ্লবীদের বিষয়ে একটি কথাও বের করতে পারেননি কাশীর জেলের দুঁদে  বাঙালি অফিসার পুলিশ সুপার জিতেন ব্যানার্জি। তাঁর  গায়ে লঙ্কাবাটা লাগানো হয়েছে জেলের জমাদারনীকে দিয়ে। অসহ্য জ্বালা সহ্য করলেও টুঁ শব্দটি বের করা যায়নি তাঁর মুখ থেকে। তারপর শেষ চেষ্টা হিসেবে তাকে সুপার জেলের প্রাচীর এর বাইরের দিকে স্যাঁতস্যাঁতে আলো-বাতাসহীন অন্ধকার আন্ডারগ্রাউন্ড সেলে একাকী আটকে রেখেছেন দিনের পর দিন। প্রতিদিন সেই সেলে একলা আটকে রাখার সময় বাড়িয়েছেন অল্প অল্প করে। একদিন সেই আলো-বাতাসহীন সেলে 45 মিনিট আটকে রাখার পর তাকে অচৈতন্য অবস্থায় বের করে আনা হলো তার পরেও তার মুখ থেকে একটি কথা বের করা যায়নি। এরপর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল কলকাতা আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। আলিপুর জেলে তাঁর ওপর লাগাতার  পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে অনশন শুরু করলেন ননীবালা। লাগাতার 21 দিন অনশনের পর প্রতিদিনের মতো সেদিনও তাকে জেরা করার জন্য সেল থেকে গোয়েন্দা অফিসে আনা হয়েছিল। সাহেব তাকে বারবার অনশন তুলে নেবার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি বলে বসলেন, “অনুষ্ঠান তুলে নিতে পারি, একটি শর্তে! আমাকে বাগবাজারে রামকৃষ্ণদেবের সহধর্মিনী শ্রীসারদা মার কাছে রেখে আসতে হবে!”
          সাহেব বললেন, চিঠিতে লিখে দিতে। কাগজ কলম দেওয়া হল তিনি চিঠি লিখলেন। চিঠি হাতে নিয়ে মুচকি হেসে সাহেব চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলে দিলেন বাজে কাগজের ঝুড়িতে।অপমানের ফল  মিললো হাতে হাতে, সাহেবের গালে পড়লো সপাটে এক চড়। দ্বিতীয় চড়টি গোয়েন্দা অফিসার মিস্টার গোল্ডির সাহেবের গালে পড়ার আগেই তাঁর হাত চেপে ধরেছেন অফিসের অন্য কর্মীরা।হাত চেপে ধরা অবস্থাতেই বাঘিনীর মতো গর্জে চলেছেন ননীবালা।বলছেন, “এতো বড়ো স্পর্ধা তোমাদের? আমাদের দেশের মানুষ পরাধীন বলে কি কোনো মান- সম্মান নেই? চিঠিটা যদি ছিঁড়েই ফেলবে তবে লিখতে বলেছিলে কেন?”অনশনের 21দিন পরেও এই স্পর্ধা, মনোবল আর তেজ দেখে সবাই বিস্মিত।
            1818 সালে রাজবন্দী হিসেবে প্রেসিডেন্সি জেলে চালান হলেন তিনি। ননীবালা দেবী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার প্রথম রাজবন্দী। 1916 সালে ধরার পড়ার পর থেকে  1919 পর্যন্ত প্রায় চার বছরের মাথায় মুক্তি পেলেন ননীবালা দেবী। অসুস্থ ননীবালার তখন মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকুও ছিলনা। কোন পূর্ব পরিচিত অনুগ্রহে তিনি একটি কুঁড়ে ঘর ভাড়া পেলেন হুগলিতে। সুতো কেটে, রান্নার কাজ করে কোনমতে তাঁর দিন কাটতে থাকে। কেউ সে সময় তাঁর খবরও নেয়নি। অবশেষে মৃত্যু এসে তাঁকে সেই অবস্থা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যায় অমরধামে 1967 সালে। কেউ মনে রাখেনি তাঁর এই আত্মত্যাগের কথা। 


দুকড়িবালা দেবী

    যিনি ইংরেজদের মনে ভীতির কারণ ছিল! বীরভূমের মাসিমা প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি অস্ত্র আইনে দণ্ডিত হন, তার দেশ প্রেম ও সাহসিকতার পরিচয় মেলে তার কাজে তিনি দুধের সন্তান রেখে জেলে যান । তার কাছে মাতৃত্ব অপেক্ষা স্বাধীনতার লড়াই প্রাধান্য পায় । অনেক মানুষের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং জীবনের বিনিময় ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল ব্রিটিশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। পেয়েছিল তার বহু-কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা আন্দোলনে সারা দেশ তথা বাংলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বীরভূম জেলাও। ব্রিটিশ শক্তির বিরোধিতায় এই জেলাতেও সংগঠিত হয়েছিল একাধিক আন্দোলন। ১৮৫৫ সালে সিধো-কানহুর নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ দানা বাঁধে। সে সময়ের সাঁওতাল পরগনার পাশাপাশি বীরভূমের উত্তর-পশ্চিমের বেশ কিছু অংশ এই বিদ্রোহের কেন্দ্রভূমি হয়ে ওঠে। ওই সময় সিউড়ি শহর-সহ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ব্রিটিশ কবল থেকে মুক্ত করার লড়াইয়ে শামিল হন তাঁরা। পরবর্তী সময়ে জেলার সর্বস্তরের মানুষই স্বাধীনতা আন্দোলনে নেমে পড়েন। এক সময় সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও যুক্ত হয়েছিলেন এই সংগ্রামে। শুধু তারাশঙ্করই নন, কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাবা), জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পান্নালাল দাশগুপ্ত, জগদীশ ঘোষ-সহ বীরভূমের শতাধিক বিপ্লবী ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে যোগ দিয়েছিলেন।
           জেলার বিপ্লবী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য নামটি হল দুকড়িবালা দেবী। নলহাটির ঝাউপাড়া গ্রামের খুব সাধারণ পরিবারের এক গৃহবধূ তিনি। ইংরেজদের দখলদারি মনোভাবকে মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ স্পর্শ করে তাঁকেও। মনে মনে স্বদেশি মন্ত্রে  দীক্ষিত হন তখনই। পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ হয় তাঁরই এক আত্মীয়, বিপ্লবী নিবারণ ঘটকের সঙ্গে। সম্পর্কে নিবারণের মাসি ছিলেন দুকড়িবালা। নিবারণের সূত্রেই ঝাউপাড়ার দুকড়িবালা দেবীর বাড়ি হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের আখড়া। বিপ্লবীদলে দুকড়িবালা দেবী ‘মাসিমা’ নামেই পরিচিত ছিলেন। বিপ্লবীদের কাছ থেকে দুকড়িবালাও শিখে নেন বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রচালনার কলাকৌশল। ১৯১৪ সালের ২৬ আগস্ট কলকাতার রডা কোম্পানির জন্য পাঠানো ৫০টি জার্মান মসার পিস্তল এবং বহু সংখ্যক কার্তুজের বাক্স কলকাতা বিমানবন্দর থেকে লুট হয়। সশস্ত্র বিপ্লবীরাই এই অস্ত্র লুটের পিছনে ছিলেন। সেই লুট হওয়া পিস্তল ও কার্তুজের একটি বড় অংশ এসে পড়ে ঝাউপাড়ায়। সে-সব সামলে রাখার দায়িত্ব নেন দুকড়িবালা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অস্ত্র রাখার অভিযোগে ১৯১৭ সালের  ৮ ই জানুয়ারি পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। বিচারে দু’বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম বিপ্লবী মহিলা, যাঁর ওই সময় অস্ত্র আইনে সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।
             বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যথেষ্ট সক্রিয় ছিল এই জেলা। ১৯০৫ সালের ১৯ জুলাই বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। ওই বছরই ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে সারা বাংলার সঙ্গে বীরভূম জেলাও প্রতিবাদে সরব হয়। জেলার বহু গ্রাম ও শহরে পালিত হয় ‘অরন্ধন’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনায় পালন করা হয় ‘রাখি বন্ধন’ উৎসব। ডাক দেওয়া হয় বিদেশি দ্রব্য বয়কটের। গ্রামে গ্রামে বের হয় শোভাযাত্রা। শামিল হন অগণিত সাধারণ মানুষ। ১৯২০ সালে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে জেলার ছাত্রেরা স্কুল-কলেজ বর্জন করেন। ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বরে এই আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস সিউড়ি,  সাঁইথিয়া এবং রামপুরহাটে জনসভা করেন। নবীনচন্দ্র সেন, গোপীকা বিলাস সেনগুপ্তদের মতো জেলার কংগ্রেস নেতারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পরে ১৯২৫ সালের ২২ জুলাই গাঁধীজি সিউড়ি শহরে একটি জনসভা করেন। সেখানে তিনি তাঁর বক্তব্যে দেশের কল্যাণের জন্য সম্প্রীতির বাতাবরণ সৃষ্টি করার দিকে জোর দেন। বলেন, অস্পৃশ্যতা বর্জনের কথাও। ১৯৩০ সালে তাঁরই ডাকে লবন আইন অমান্য আন্দোলনে শামিল হয়ে বীরভূমের শরৎচন্দ্র মুখোপাধ্যায়-সহ কয়েক জন গ্রেফতার বরণ করেন। তবে এ সময় গাঁধীজির গণ-আন্দোলনের ডাকে তদানীন্তন সশস্ত্র বিপ্লবীরা সাড়া দেননি। বরং তাঁরা অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর দলের সদস্যদের নিয়ে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন। তবে, বাংলার সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনে বীরভূমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিচিতি বোধহয় ইতিহাস-খ্যাত ‘বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা’-র সৌজন্যে। ১৯৩০ সালের আগে ও পরের কয়েকটি বছর বিপ্লবীরা অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ এবং জোরপূর্বক অৰ্থ সংগ্রহের অভিযানে সামিল হন। শাসকের চোখে যা ছিল  সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ। অস্ত্র ছিনতাই, ডাক লুট-সহ নানা কাণ্ডকারখানা শুরু হয় জেলা জুড়ে। জেলার সিউড়ি, দুবরাজপুর, লাভপুর, আমোদপুর, জাজিগ্রাম, ভালাসের মতো বিভিন্ন শহর এবং গ্রামকে বেছে নেওয়া হয় এই সব কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র হিসাবে। কিন্তু কয়েক জন বিপ্লবীর বৈপ্লবিক দৃঢ়তার অভাবে ফাঁস  হয়ে যায় আন্দোলনকারীদের গোপন কার্যপ্রণালী। ফলে পুলিশ জেলার বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালিয়ে ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করে। বিপ্লবীদের এই কাজ ব্রিটিশরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত হয়। ১৯৩৪ সালের ১৪ জুলাই ২১ জন বিপ্লবীর নামে অভিযোগ দায়ের হয়। ২৬ জুলাই সিউড়ি আদালতে মামলা শুরু হয়। এই মামলাটিই ‘বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে পরিচিতি পায়। টানা দু’মাস এই মামলা চলার পর ১৯৩৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রায় বের হয়। মামলার রায়ে ১৭ জন বিপ্লবীকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। প্রভাতকুমার ঘোষ, রজতভূষণ দত্ত, সমাধীশ রায়, হারানচন্দ্র খাঙ্গার সহ দশ জনকে ‘বিপজ্জনক বিপ্লবী’ হিসেবে চিহ্নিত করে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়।
          ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’  আন্দোলনেও এই জেলার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ৯ অগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হলেও বীরভূমে আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়েছিল ১৩ অগস্ট। আন্দোলনের সমর্থনে স্কুল-কলেজের ছাত্রেরা পথে নেমে পড়েছিলেন। জায়গায় জায়গায় শুরু হয় পিকেটিং। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত, নৃসিংহ সেনগুপ্ত, দ্বারকেশ মিত্র, লালবিহারী সিংহ প্রমুখ। ওই বছরই ১৫ অগস্ট সিউড়ি শহরে জেলার শতাধিক বিপ্লবী বীরভূম জেলাকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। এর পরেই শুরু হয় পুলিশি তৎপরতা। গ্রেফতার করা হয় বহু নেতাকে। ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে বীরভূমের প্রাচীন জনপদ দুবরাজপুরেরও এক সমৃদ্ধ ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। ’৪২-এর ১ সেপ্টেম্বর মিছিল করে আক্রমণ করেছিল দুবরাজপুর আদালতের উপরে। তৎকালীন ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ভারতের জাতীয় পতাকা। আন্দোলন, গ্রেফতার এবং বিপ্লবীদের জেলবাসের ফলে সিউড়ি জেলখানাও নানা ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী হয়ে উঠছিল। এই জেলেই বন্দি ছিলেন সাঁওতাল বিদ্রোহের তিন নায়ক কানহু, চাঁদ ও ভৈরব। বন্দি ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম সৈনিক বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী। স্বদেশি করার ‘অপরাধে’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও বন্দি ছিলেন এখানে। এই জেলে বসেই তিনি রচনা করেন ‘চৈতালী ঘূর্ণি’র মতো উপন্যাস। এ ছাড়াও ‘বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা’-র বেশ কয়েক জন বিপ্লবী বন্দি-জীবন কাটিয়েছেন সিউড়ি জেলে। স্বাধীনতা সংগ্রামে এই জেলার বিপ্লবীদের অবদান যে কোনও অংশেই কম ছিল না, জেলার মাটিতে জন্ম নেওয়া নানা বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহের  ব্যাপকতাই তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি বিনা দোষে জেল খাটেন । ২৮ এপ্রিল, ১৯৭০ সালে দুকড়িবালা দেবী মারা যান ।

তথ্যসূত্র

Wikipedia

Comments

  1. নতুন কিছু জানলাম।ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. Enader somporke jantm na jene vlo laglo aro ojana itihas jante chai dada

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, চেষ্টা করেছি মাত্র ।

      Delete
  3. দারুণ জিনিস

    ReplyDelete

Post a Comment

If you have any doubt, please let me know.

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে