সম্মোহনের ইতিকথা - শুভজিৎ দে

অনেক দিন থেকে তেমন কিছু লেখা হয় না, আদতে গতচার মাস ঘরের বাইরে যাওয়া হয়নি, তাই হয়তো সেভাবে পেন চলেনি, আজ ব্লগ লেখার অন্য একটি কারণ আছে আর তা হল আমার খুব পছন্দের একটি বিষয়, মাধ্যমিকের পর ভাই ও কিছু বন্ধুর সাথে এর চর্চা শুরু করি, আর এই পছন্দের বিষয় হচ্ছে সম্মোহন, স্কুলের ( গার্ডেনরীচ উচ্চমাধ্যমিক স্কুল ) গ্রন্থাগার থেকে একটি বই পেয়ে এই বিষয়ে অগ্রহের উদ্রেক হয়। বড়ির বড়দের অজান্তেই এই চর্চা চালাতাম, একদিন ধরা পড়ে যাওয়ায় তা বন্ধ করতে হয়, কিন্তু ততদিনে সেই বই থেকে বেশকিছু প্রণালী আমি লিখে নিয়েছিলাম, এবং তা প্রায় সেই সময় একপ্রকার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কালের নিয়মে পড়াশোনার আর খেলার  আড়ালে সম্মোহন চর্চা আর করা হয়ে ওঠেনি, তবে এতদিন পর পুরোনো বইখাতা গুছিয়ে দেখতে গিয়ে সেই সম্মোহন বিষয়ক প্রণালী লিখে রাখা খাতাটি খুঁজে পাই, তাই আজ ঠিক করলাম, সেই প্রণালীর গুলির সাথে সাথে এই বিষয়ের কিছু তথ্য ভাগ করেনি আপনাদের সাথে।

মাধ্যমকে সম্মোহন করা হচ্ছে

ইতিহাস বলে সম্মোহন বা হিপনোটিজম (HYPNOTISM) বেশ প্রাচীন বিদ্যা, ইতিহাসের পাতায় খুঁজে দেখলে এর পরিচয় পাওয়া যাবে জাদু বিদ্যা বলেই, এমনকি কেউ যদি অন্য কোনো ব্যক্তিকে সম্মোহন করতেন, তবে সাধারণ মানুষ সকলেই মনে করতেন সেই ব্যক্তির মধ্যে কোনো দৈব ক্ষমতা আছে। অনেকেই সম্মোহন বিদ্যাকে প্রাচীনকালের তন্ত্রসাধনার সাথে এক বলে মনে করতেন, সেকালে মানুষ এই বিদ্যাকে যাদুবিদ্যা, বশীকরণ বিদ্যা বা অলৌকিক ক্ষমতা বলে বিশ্বাস করতেন । অষ্টাদশ শতকে সম্মোহন বিদ্যার নামকরণ হয় ‘মেজমেরিজম’।

ড. ফ্রাণ্ডস্ অ্যান্টন মেজমার

অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরের ড. ফ্রাণ্ডস্ অ্যান্টন মেজমার সম্মোহন বিদ্যার চর্চা শুরু করেন। ফলে এর ব্যাপক প্রচার শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘মেজমেরিজম’। তবে 1840 সালে স্কটল্যান্ডের ড. জেমস ব্রেড এই বিদ্যার নাম দেন 'হিপনোটিজম', এই নামের অন্তরালে অবশ্য এক বিশেষ অর্থ আছে, হিপনোটিজম শব্দটি গ্রিক শব্দ হিপনোস (HYPNOS) থেকে আগত, এই গ্রিক শব্দটির অর্থ হচ্ছে " ঘুম ", আর যেহেতু সম্মোহিত ব্যক্তি ঘুমের ঘোরেই সম্মোহকের আদেশ পালন করে তাই এই বিদ্যাকে হিপনোটিজম বলা হয়।

ড. জেমস ব্রেড

এই বিদ্যার দ্বারা আপনাকে কেউ যখন সম্মোহন করবে, তখন আপনার অবচেতন মন বা Subconscious mind এ অনুভূত তাই হবে যা সম্মোহনকারী অনুভূত করাতে চাইবে। ধরে নিন এখন গ্রীষ্মকাল কিন্তু, আপনি যাকে সম্মোহন করলেন তাকে আপনি বললেন এখন শীতকাল। সম্মোহিত ব্যাক্তি তখন হিপনোটাইজড থাকা অবস্থায় ঠক ঠক করে কাঁপা শুরু করবে, প্রবল শৈত্য প্রবাহে যেমন করে মানুষ কাঁপে ঠিক তেমন ভাবেই। সম্মোহিত ব্যাক্তি ঐ নির্দিষ্ট সময়টায় নিজেকে কানা, খোঁড়া, অন্ধ, বাক শক্তিহীন সবকিছুই ভাবতে পারে, আপনি তাঁকে সম্মোহিত অবস্থায় থাকাকালীন, ধরুন বললেন তুমি বোবা, তুমি কথা বলতে পারবে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঐ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সে সত্যিই বিশ্বাস করবে সে বোবা, এবং কথা বলতে পারবে না! এবং সম্মোহন ভেঙ্গে যাওয়ার পর সেই ব্যক্তি ওই নির্দিষ্ট সময়ে কী কী ঘটেছে এবং সে কী কী করেছে, তার কিছুই মনে রাখতে পারে না।

এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন না

ইংল্যান্ডে একজন দাঁতের ডাক্তার ছিলেন। তার নাম ডা. এস ডেল। তিনি অবশ করার কৌশল ব্যবহার না করে রোগীকে সম্মোহিত করে দাঁত তুলে নিতেন। দাঁত উঠানোর সফলতা কাজে লাগিয়ে হিপনোটিজম ব্যবহার করে তিনি এরপর ফুসফুসের অস্ত্রোপচারও করেন, জটিল অপারেশনের সময় রোগীর মনে যে চাপ পড়ে, দুশ্চিন্তার তৈরি হয় সেসব দূর করা সম্ভব সম্মোহন করে।

সংক্ষিপ্ত ভিডিও

এতো ভালো দিক জানলাম। সম্মোহনের অপব্যবহারেরও উদাহরণ আছে অজস্র। আমেরিকা ও ব্রিটেনের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী একদল মানুষের ওপর হিপনোটিজমের প্রভাব কতখানি কার্যকর হয় সেটি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তারা দেখতে চেয়েছেন যে, সম্মোহন করে একজন নিরেট ভদ্র ভালো মানুষকে খুনি বানানো সম্ভব কি না! গবেষণার ফল হয়েছিল যে, একজন সাধারণ মানুষকে হিপনোটাইজ করে সত্যি সত্যি তাকে দিয়ে মানুষ খুন করানো সম্ভব! সম্মোহিত হয়ে সে একজন মানুষকে অবলীলায় খুন করে আসবে এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে সম্মোহন ভেঙ্গে গেলে এই খুনের কোনো কথাই তার মনে থাকবে না।

বইটির লিংক নিম্নে দেওয়া হয়েছে

আগেই উল্লেখ করেছি, স্কুলের গ্রন্থাগার থেকে একটি বই পেয়ে, এই বিষয়ে আমার উৎসাহ সৃষ্টি হয়। সেই বই থেকে যে সব তথ্য পাই তার মাধ্যমেই এই চর্চা করতাম আমি সেই সময়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি বিষয় হচ্ছে 1. দৃষ্টি (Look) 2. স্পর্শ (Touch) 3. ইচ্ছা (Will) যেগুলির মাধ্যমে সম্মোহন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছি সেই সময়ে, নিজের অন্তরের শক্তিকে প্রধানত এই তিন প্রকারের দ্বারা অন্যব্যক্তি বা মাধ্যমের (যাকে সম্মোহন করা হচ্ছে) শরীরে সঞ্চালিত করতাম।

সংক্ষিপ্ত ভিডিও

দৃষ্টি সাধনা : প্রথমে আমরা জেনে নিই দৃষ্টি সাধনা সম্পর্কে, এখানে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি স্থির ভাবে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে তাঁকে সম্মোহন করে নিজ কার্যসিদ্ধি করা, দৃষ্টি সাধনার অংশ। প্রণালী এখানে সম্মোহক মাধ্যম বা যাকে সম্মোহিত করবেন তাঁর প্রতি একই দৃষ্টিতে (কঙ্খিত দৃষ্টিতে) চেয়ে থাকতে হবে, এই অভ্যাস অনুশীলনের নাম দৃষ্টি সাধনা।

দৃষ্টি সাধনা

স্পর্শ সাধনা : এখন আমরা জেনে নিই স্পর্শ সাধনা সম্পর্কে, সাধারণ কথায় স্পর্শের মাধ্যমে সম্মোহন করার উপায়কে স্পর্শ সাধনা বলে, কোনো ব্যক্তিকে সম্মোহন করার জন্য সম্মোহনকারী তার হাতের আঙ্গুল গুলিকে সমদূরত্ব বজায় রেখে কম্পমান ভাবে মাধ্যম বা পাত্রের উপর দিয়ে হাত চালনা করাকে স্পর্শ সাধনা বলে, স্পর্শ সাধনাকে দুইভাগে ভাগ করা যায়, A. উদ্ধগামী পাস B. নিম্নগামী পাস, এগুলিও আবার স্পর্শযুক্ত ও স্পর্শহীন হয়ে থাকে,

স্পর্শ সাধনা

স্পর্শযুক্ত পাসগুলি হচ্ছে - 1. শক্তি সঞ্চারিনী, 2. আকর্ষণী, 3. বিকর্ষণী, 4. উত্তলনী, 5. অলৌকিকক্রিয়াকলাপ,

স্পর্শহীন পাসগুলি হচ্ছে - 1. শক্তি সঞ্চারিনী, 2. অলৌকিকক্রিয়াকলাপ।

উদ্ধগামী - হাত নীচের দিক থেকে উপরের দিকে উঠবে।
নিম্নগামী - হাত উপরের দিক থেকে নীচের দিকে আসবে।

ইচ্ছা সাধনা : এবার আমরা জেনে নিই ইচ্ছা সাধনা সম্পর্কে, দৃঢ় মনের ইচ্ছাশক্তি দ্বারা সম্মোহন করাকে ইচ্ছা সাধনা বলে। এখানে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে "ইচ্ছা", কঠিন ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে মনে মনে ইচ্ছা শক্তিদ্বারা যাকে সম্মোহন করবেন তাঁকে আদেশ দিতে হবে, এই আদেশ দেওয়াই হচ্ছে ইচ্ছা সাধনা।

ইচ্ছা সাধনা


বি. দ্র : আলোচনা থেকে বিরত রাখলাম, উক্ত পাঁচটি পাসের বিস্তারিত বিবরণ।

তথ্যসূত্র 

  • সম্মোহন বিদ্যা - রাজেন্দ্রনাথ রুদ্র
  • বিভিন্ন্য বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম
  • চিত্রঋন - ইন্টারনেট

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে