ভারতের যুবক দধিচী যতীন দাস - শুভজিৎ দে

তাঁর যখন বয়স 17, যুবক যতীন দাস অনুশীলন সমিতিতে বৈপ্লবিক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত হলেন। 1921 সালে তিনি গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন। আজ তাঁর 91 তম মৃত্যুবার্ষিকী, তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।

যতীন দাসের মৃত্যু সংবাদ 
লাহোরের সংবাদ পত্রে

যতীন দাস বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র, তিনি গভীর ভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তী কালে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় ময়মনসিংহের সেন্ট্রাল জেলে। যখন তিনি বন্দী ছিলেন সেই অবস্হায় দেখেন জেলবন্দীদের কিরকম খারাপ ও নোংরা পরিষেবা প্রদান করা হয়। জেলবন্দীদের সাথে কিভাবে বাজে ব্যবহার করা হয়। তিনি এর প্রতিবাদে 20 দিন ব্যাপী অনশন করলেন। 20 দিন পর জেল সুপারিটেন্ডেন্ট এর জন্য ক্ষমা চাইলে তিনি অনশন প্রত্যাহার করেন।

সারা দেশ জুড়ে তখন বৈপ্লবিক কার্য্যকলাপ চলছে। সেসময় তিনি ভগৎ সিং এর আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বোম বাঁধার কর্মশালায় যোগদান করেন। শচীন্দ্র নাথ সান্যাল নামে একজন বিপ্লবী তাঁকে বোম বাঁধার শিক্ষা দেন। কিভাবে ফর্মূলা অনুযায়ী বোম বাঁধতে হয়। তিনি সেটির শিক্ষা দিলেন। 1929 সালের 14 ই জুন ব্রিটিশ পুলিশ বৈপ্লবিক কার্য্যকলাপ চালানোর জন্য ও লাহোর ষড়যন্ত্র কেসে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করেন। এরপর তাঁকে লাহোর জেলে রাখা হয়। লাহোর জেলে যতীন দাসের অনশন শুরু করার অনেক কারণ ছিল। প্রত্যেকটা কয়েদীদের মতো তিনিও চেয়েছিলেন জেলে যেন সবকিছু সমান হয়। ইউরোপীয়ান কয়েদিদের বেশী সুযোগ সুবিধা প্রদান করা আর দেশীয় কয়েদিদের ক্ষেত্রে ভিন্ন নিয়ম, এটা চলতে পারে না। ভারতীয় কয়েদির পোষাক দীর্ঘদিন ধোঁয়া হোতো না। তাঁদের খাবারে ইঁদুর, আরশোলা মুখ দিত। কোনোভাবেই তা খাওয়ার উপযুক্ত ছিল না। অথচ দিনের পর দিন এই খাবারই পরিবেশন করা হতো। দেশীয় কয়েদীদের পড়ার বা লেখার কোনো জিনিষ দেওয়া হতো না সেই সময়, তা চাইলেই দুরব্যবহার করা হতো। অথচ ব্রিটিশ জেলবন্দীদেরকে অন্য রকম ব্যবহার করা হতো। যতীন দাস এসবের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করে অনশনে বসেছিলেন।

যতীন দাস

যতীন দাস 1929 সালের 13ই জুলাই অনশন শুরু করেন। এরপর 63 দিন তিনি অনশন চালিয়ে যান। জেল কর্তৃপক্ষ অন্যা্ন্য অনশনরতদের পাশাপাশি তাঁকেও জোর করে খাওয়ানোর প্রচেষ্ঠা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। একসময় জেল পরিচালন কমিটি তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তা মানতে চান নি। তাঁর দাবি ছিল, রাজবন্দিদের উন্নত মর্যাদা। হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের বিপ্লবী কর্মী যতীন দাস তাঁর অনশন দিয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন গোটা দেশকে। 13 সেপ্টেম্বর মাত্র 24 বছর বয়সে 63 দিন অনশন করে মৃত্যবরণ করেন যতীন দাস, লাহোরের বোরস্টাল জেলে তাঁকে জোর করে খাবার খাওয়াতে গিয়ে মৃত্যু হল তাঁর।

তাঁকে সুভাষ চন্দ্র বোস অভিহিত করেন ‘ভারতের যুবক দধিচী’ নামে। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর শবদেহ সরাসরি লাহোর থেকে ট্রেনে নিয়ে আসা হয় হাওড়া স্টেশনে। সেদিন কয়েক লক্ষ মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাওড়া স্টেশনে হাজির ছিলেন। প্রায় আড়াই মাইল লম্বা মিছিল করে তাঁকে শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয় হয়। সুভাষ চন্দ্র বোস তাঁর কফিন বহন করেছিলেন। ঐতিহাসিকরা বলেছেন, যতীন দাসের মৃত্যু স্বদেশী আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছিল। তাঁর দেহ নিয়ে যে উন্মাদনা হয়েছিল তাতে ঘাবড়ে গিয়ে এরপর থেকে আর ব্রিটিশরা শহিদদের দেহ তাদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ভগৎ সিং, শুকদেব, রাজগুরুর দেহও দেওয়া হয়নি তাঁদের পরিবারকে। শতদ্রুর তীরে মাঝরাতে গোপনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।

শ্মশান ঘাটে যখন চন্দনকাঠের চিতা ওপর যখন তাঁর দেহ তোলা হয়, তখন তাঁর পিতা বঙ্কিম বিহারী দাসের বানী পাঠ করলেন শ্রী হেমেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত –

" ওঁ নারায়ণ! যে বিশ্বাসঘাতকতায় মগ্ন হয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই দেশকে বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়েছিল, তারই প্রায়চিত্ত স্বরূপ আমি আমার আদরের পুত্রকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। অশ্রুজল ভিজিয়ে আমার খেঁদুকে তোমার পায়ে সমর্পণ করলাম। তার এই আত্ম বিনাশের মধ্য দিয়ে সমগ্র ভারত যেন জেগে ওঠে।"

তথ্যসূত্র 


  • চিত্রঋণ - Wikipedia
  • বিভিন্ন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম
  • যতীন দাস - রণজিত রায়


Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে