সুলতানার স্বপ্ন ও কল্পরাজ্য- শুভজিৎ দে

সুলতানার স্বপ্ন ভারতবর্ষের অগ্রণী নারীবাদী লেখিকা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রচিত একটি উপন্যাসিকা। গ্রন্থটি 1905 সালে মাদ্রাজের দ্য ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিনে সুলতানাস ড্রিম শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়। 1908 সালে উপন্যাসিকাটি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। এটি ইংরেজি ভাষায় রচিত, বাংলা ভাষায় এটি প্রকাশিত হয় 1922 সালে।

সুলতানার স্বপ্ন বইয়ের প্রচ্ছদ ও বেগম রোকেয়া

এই উপন্যাসটির মূল বক্তব্য অনেকটা এইরকম, রাজা নয়, রাণীও পারেন কল্পলোককে নিয়ন্ত্রণ করতে, যেমন পেরেছেন বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামক কল্পকাহিনীতে। রোকেয়া বন্দিনী ছিলেন। সেটা বোঝা যাবে তাঁকে যদি তাঁর পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে স্থাপন করি। জন্ম 1880 তে। কলকাতা থেকে অনেক দূরে, রংপুরে। পিতা ছিলেন বিত্তবান, কিন্তু অপব্যয়ী ও রক্ষণশীল। দুই ছেলেকে তিনি কলকাতায় রেখে সাহেবদের স্কুলে পড়িয়েছেন; কিন্তু মেয়েদের শিক্ষায় বিশ্বাস করতেন না। রোকেয়ার বিয়ে হয়েছে 16 বছর বয়সে। স্বামী উচ্চ শিক্ষিত, বিলেত গিয়েছিলেন ডিগ্রী আনতে, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন চাকরিতে, বেগম রোকেয়াকে উৎসাহিত করেছেন লিখতে। কিন্তু স্বামী ছিলেন উর্দুভাষী, থাকতেন তিনি বাঙলার বাইরে ভাগলপুরে। দুঃখ করে বেগম রোকেয়া লিখেছেন, 14 বছর তার ভাগলপুরে কেটেছে, যেখানে একজন বাঙালি ছিলো না যার সঙ্গে বাঙলায় কথা বলবেন, তারপর কলকাতা এসে প্রথম 11 বছর তিনি একটি উর্দু বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা করেছেন। যেখানে ছাত্রী, শিক্ষিকা, কর্মচারী সবাই ছিলো উর্দুভাষী। বেগম রোকেয়া বাঙলা ও ইংরেজি শিখেছেন নিজের চেষ্টায়।

বেগম রোকেয়া

সুলতানাস ড্রিম’ও এক বিষ্ময়কর লেখা। সে কল্পলোকের কাহিনী। কাহিনীটি যিনি বলছেন তার নাম সুলতানা। তার ধারণা তিনি জেগেই ছিলেন। কিন্তু আসলে তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। দেখেন তিনি এক আশ্চর্য জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নাম তার নারীস্থান। এখানে মশা নেই, পুলিশ নেই, অশান্তি নেই। কারণ কি? কারণ একটাই। পুরুষ এখানে শৃংখলাবদ্ধ। ভগিনী সারা নামে যে মহিলা সুলতানাকে সঙ্গ দিচ্ছেন, সে বলছে, স্বয়ং শয়তান যেখানে শৃংখলাবদ্ধ সেখানে শয়তানীর সুযোগ কোথায়? মেয়েরা তাই ভারী নিরাপদ। এখানে পুরুষরা অন্তপুরে থাকায় মেয়েরা তাই ভারী নিরাপদ। তারা ঘরে থাকে এবং দেহের কাজ করে। মেয়েরা করে মস্তিষ্কের কাজ। পুরুষ বন্দী হলো কেনো? সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, আদতে পুরুষ বন্দী নিজের ব্যর্থতায়। পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে কয়েকজন বিদ্রোহী, যারা ওই রাজ্যের দুঃশাসন মেনে নিতে পারেনি, তারা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো এই রাজ্যে। এ রাজ্যের রাণী তাদের আশ্রয় দেওয়ায় লাগলো যুদ্ধ। দলে দলে সৈনিকরা আহত ও নিহত হতে লাগলো। রাজ্য বিপন্ন, পুরুষ নিঃশেষ প্রায়। কি করা যায়? সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আহার নিদ্রা বন্ধ হবার উপক্রম। শেষে এগিয়ে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনি মহিলা এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র নেই, সবাই ছাত্রী। দুই হাজার স্বেচ্ছাসেবিকা নিয়ে রওনা দিলেন। না, সীমান্ত পর্যন্ত যাননি তারা। হাতাহাতি করেননি শত্রুপক্ষের সঙ্গে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগৃহীত সূর্যের কিরণ দূর থেকে নিক্ষেপ করেছেন শত্রুপক্ষের দিকে। তারা পালিয়ে বাঁচে না, যুদ্ধ করবে কী। যুদ্দযাত্রার আগে, অধ্যক্ষা শর্ত দিয়েছিলেন পুরষদের সবাইকে অন্তপুরে প্রবেশ করতে হবে। পর্দার প্রয়োজনে এটা আবশ্যক। সেই থেকে পুরুষরা সবাই ঘরে থাকে। মেয়েরা আছে বাইরে। 

চিত্রঋণ - CHITRA GANESH

সুলতানা পুরুষশাসিত পরাধীন ভারতবর্ষের মেয়ে, চলাফেরায় দ্বিধা ছিলো প্রথমে, লজ্জা ও সংকোচ জড়িয়ে যাচ্ছিলো পা; ভগিনী সারা বললেন, “এ রাজ্যে অমন পুরষপনা চলবে না, মেয়েরা এখানে স্বাচ্ছেন্দ্যে চলে।” বেগম রোকেয়ার এই লেখাটি তাঁর স্বামী এক নিঃশ্বাসে পড়েছিলেন; পড়ে ইংরেজিতে বলেছিলেন, “এ একটি ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ।” হ্যাঁ, তাই। কিন্তু ব্যক্তিগত নয়। প্রতিশোধটা সমষ্টিগত। তাছাড়া পুরষকে বন্দী করা রোকেয়ার লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য নারীকে মুক্ত করা। যে জন্য তিনি বিজ্ঞানকে নিয়ে এসেছেন তার এই লেখায়। প্রতিশোধ নয়,আসলে তিনি চান মুক্তি। ওই কল্পরাজ্যে দুটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।  তার লক্ষ্য মেয়েদেরকে পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়া নয়, সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়। এ হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৃষ্টিশীল গবেষণাকেন্দ্র। 

চিত্রঋণ - CHITRA GANESH

বেগম রোকেয় তার সব লেখাতেই সমান সাহসী। তিনটি উদাহরণ দিই। স্ত্রী জাতির অবনতি নামে প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “কোন ভগ্নী মস্তকোত্তলনের চেষ্টা করিয়াছেন, তখনই কর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন স্বরুপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। দাসত্বের নিদর্শন প্রবন্ধে লিখেছেন, কারাগারে বন্দীগণ লৌহনির্মিত বেড়ী পরে আমরা আদরের জিনিষ বলিয়া, স্বর্নরৌপ্যের বেড়ী অর্থ্যাৎ মল পরি। আবার মজা দেখুন, যাহার শরীরে দাসত্বের নিদর্শন যত অথিক, তিনি সমাজের ততোধিক মান্যাগন্যা।” এ প্রবন্ধ 1905  সালে লেখা।

চিত্রঋণ - CHITRA GANESH

আলাদা ভাবে বেগম রোকেয়ার পরিচয় দেবার কিছুই নেই, তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূত। নারী শিক্ষার পথ প্রদর্শক, এসব পরিচয়ের আড়ালে তাঁর লেখা হয়ে উঠেছে সমাজ সংস্কারের বাহক, তুলনামূলক ভাবে সাহিত্যমূল্য, রচনার অভিনবত্ব অনেকটা আড়ালে থেকেছে, সুলতানার স্বপ্ন গল্পটির নারী অন্দোলনের দিকটি ছাড়াও আরও অনেক ভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখলেও তা নারীবাদী রচনার বিত্তেই থেকে গেছে, সেযুগে মেয়েরা মাতৃভাষা বাংলায় শিক্ষা পেত না, আর সে সময়ে রোকেয়ার ইংরেজি এই লেখাটিতে শান্তির সহবস্থান দেখা যায়, যেখানে যুদ্ধনয়, যুক্তি-বিদ্যা-বুদ্ধিই নারী জাতির প্রেরণা। বিশ্বাস আর ভালোবাসাই মানব জাতির মূল মন্ত্র। সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক সময়ে রোকেয়ার রাষ্ট্রচেতনা আধুনিকতার পরিচয় বাহক। 


তথ্যসূত্র : 

1. বিদ্যাসাগর থেকে বেগম রোকেয়া, শিশুশিক্ষার সারথি - কাজী সুফিউর রহমান

2. শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ - বেগম রোকেয়া

3. বেগম রোকেয়া রচনাবলী - মোস্তাফা মীর (সম্পাদনা)

4. Sultanas Dream - বেগম রোকেয়া

5. Wikipedia

চিত্রঋণ - CHITRA GANESH

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে