আজও যুদ্ধাপরাধী নেতাজী - শুভজিৎ দে

বিদেশিদের কাছে অনেক সুপার হিরো থাকতে পারে, কিন্তু ভারতীয়দের হৃদয়ে তিনিই সুপার হিরো, তিনিই নেতা, সকলের নেতাজী । 



যিনি বলছেন, " স্বাধীনতা ভিক্ষা করে নয়, ছিনিয়ে নিতে হয়," বা " তোমার আমায় রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো । " যাঁর আজ একশো তেইশতম জন্মদিন, যাঁর মৃত্যুদিন অনেকেই বলে থাকেন 18 ই অগাস্ট 1945, তবে আপামর জনসাধারণ আজও বিশ্বাস করেন তিনি ফিরবেন, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তার নাম আজ ব্রিটিশ সরকারের কাছে রয়েছে, যারা আজ ও অপেক্ষা রত তার ফেরার । এই অপেক্ষা কেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৪৫ সালে যদি নেতাজীর মৃত্যু হয়েই থাকে থাকে তবে রাষ্ট্রসংঘ কেন প্রথমে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তাঁর জন্য অপেক্ষা করলো ? আবার ১৯৯৯ সালের পর তা বাড়িয়ে ২০২১ সাল কেন করলো? কিসের এত ভয়?



যে কথা সকলেরই জানা, পরাধীন দেশের রাজবিদ্রোহীকে সেদিন ব্রিটিশ তল্পিবাহক কিছু প্রভাবশালী নেতৃবর্গের অকর্মণ্যতার কারণে জীবন বাজি রেখে ছদ্মবেশে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে হয়েছিল। তিনি যখন কাবুল, কান্দাহার, আফগানিস্তানের বন্ধুর পথ ডিঙিয়ে চলেছেন, তখন ব্রিটিশ গোয়েন্দাকুল তীব্র আত্মশ্লাঘায় দহনসিক্ত। প্রকাশ্যে তারা সুভাষ বোসকে ভগৎ সিং বা যতীন দাসের মতো মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কৌশলে ব্যর্থ হয়েছে একাধিকবার। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে নেতাজির অন্তর্ধান তাই তাদের পরাজয়ের সমান। ফলত নেতাজিকে হত্যার ফরমান জারি করে তারা। ইউরোপযাত্রী সুভাষ চন্দ্র বোসকে দেখামাত্র গুলি করে মেরে ফেলার ফরমান ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। তবে সেটাও ব্যর্থ হয়।

জার্মানি থেকে ‘আমি সুভাষ বলছি’ বেতার ভাষণ ভেসে আসা কিংবা ডুবো জাহাজে তিন মাসের যাত্রা শেষে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গন থেকে ভারতের মূল ভূখণ্ডে নেতাজির অভিঘাতই তার প্রমাণ। শোনা যায়, ১৯৪২ ও ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিল মাসে নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন এমন সংবাদ রটানো হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী নেতাজির নানা স্তরের নেটওয়ার্ক ভেঙে দিতেই এই উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশবাহিনী। সঙ্গে এও কথিত, এতে শাপে বর হয়েছিল। তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন বিপ্লবী সুভাষ চন্দ্র বোস এই অপপ্রচারকে হাতিয়ার বানিয়ে রাশিয়ার পথে ‘হারিয়ে’ গেলেন। সঙ্গে নানা অসংগতি সৃষ্টি করে ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন নতুন পথে প্রত্যাবর্তনের ।

নেহরু নিজের ক্ষমতা ভোগের পথ নিষ্কণ্টক করতে সুভাষের বিমান দুর্ঘটনায় ‘মৃত্যু’কে প্রতিষ্ঠা করতে প্রকাশ্যে আমৃত্যু লড়েছেন এবং সেই ব্যাটন তুলে দিয়ে গিয়েছেন তাঁর অনুগত স্তাবককুলের হাতে। বারংবার ‘মৃত্যু’র আড়ালে হারিয়ে যাওয়া ‘মৃত ভূত’ সুভাষ-আতঙ্কে শুধু ব্রিটিশ নয়, নেহরুর নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটেছিল। দ্বিচারী নেহরু প্রকাশ্যে আজাদ হিন্দ যোদ্ধাদের পক্ষ নিতে লালকেল্লার বিচারসভায় যান আর সেই ১৯৪৬-এর ডিসেম্বরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলিকে চিঠি লিখে জানান আপনাদের যুদ্ধাপরাধী বোসকে রাশিয়া আশ্রয় দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছে । একদা নেতাজি অনুগত কয়েকজনকে নিজের পক্ষে নিয়ে আজাদ হিন্দ ফান্ড ও ব্যাংকের কোটি কোটি টাকার ধনসম্পদ বাঁটোয়ারা হয়ে যায় নেহেরু ও তার স্তাবকগনের মধ্যে । মূলত নেহরু অ্যান্ড কোম্পানির এই কাণ্ডটি গোপনে করার উদ্দেশ্য ছিল পরবর্তী ৩০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে সুভাষচন্দ্র যদি স্বনামে ও স্বপরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করেন তাহলে নিয়মানুযায়ী যুদ্ধ অপরাধী ‘ব্রিটিশ সাবজেক্ট’ সুভাষচন্দ্রকে আন্তর্জাতিক বিচারের সামনে দাঁড়াতে হবে এবং ভারতকে সেখানে অংশগ্রহণ করতেই হবে। নেতাজির কোর্ট মার্শাল পর্বে নেহরু থাকলে দেশের তৎকালীন জাগ্রত জনমত বিদ্রোহী হয়ে উঠত ও নেহরু সরকারের মুখ পুড়ত। কৌশলী পথে হাঁটলেন নেহরু। নেতাজি প্রকাশ্যে এলে তাঁকে শনাক্ত করতেন শিশুকন্যা কোলে তাঁর ‘স্ত্রী’। পরিকল্পনা মতো প্রকৃত সুভাষচন্দ্রকে ‘জাল’ সুভাষ ঘোষণা করা হত এবং তাঁর জায়গা হত কারাগারে। সুভাষচন্দ্রের পরিবারও স্বাভাবিকভাবেই ‘স্ত্রী কন্যা’র গল্প মেনে নিতে পারতেন না সেই সময়ে । নেহরুও সেই সময় পর্যন্ত বোসবাড়ির কাউকে কাউকে সম্পূর্ণ বিশ্বাসভাজনের তালিকায় আনতে পারেননি। ‘স্ত্রী’ দ্বারা শনাক্তকৃত প্রকৃত সুভাষচন্দ্র হয়তো কাশ্মীরে বন্দি শ্যামাপ্রসাদের মতোই রহস্যজনকভাবে শেষ হয়ে যেতেন আর বিমান দুর্ঘটনায় ‘মৃত’ সুভাষকে নিয়ে দেশে কোনও ঢেউ ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হত না। আজাদ হিন্দের লুটপাটের টাকা থেকে নয়, ভারত সরকারের টাকা ‘স্ত্রী, কন্যা’র কাছে পাঠানোর অনেক উদ্দেশ্যর মধ্যে নেহেরুর একটি উদ্দেশ্য ছিল ওই বিদেশিনি যেন ‘স্ত্রী’র মর্যাদা নিতে এদেশে না-আসেন এবং নির্বাচিত সাংবাদিক ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে কথা না বলেন। তাতে প্রকৃত সত্য প্রকাশ হওয়ার ভয় ছিল। 

উল্লেখ্য, যে এগারোটি রাষ্ট্র আজাদ হিন্দ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তারা আজও নেতাজির ‘মৃত্যুদিন’ ঘোষণা করেনি। গত ৭০ বছরে একমাত্র ব্যতিক্রম ব্রিটিশ কমনওয়েলথ সদস্য ভারত। যাবতীয় নথিপত্র গোপন রেখে ফাটা রেকর্ডের মতোই শুধুমাত্র বিমান দুর্ঘটনা ও পাঁচমেশালি ছাইয়ের গল্প বলেছে এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে বলিয়েছে। গোপনে ছাইভস্ম রক্ষার জন্য জাপানে একসময়ে নিয়মিত টাকাও পাঠানো হতো।



ব্রিটিশ-মার্কিন গোয়েন্দারা সুভাষ বোসের জন্য হন্যে হয়ে গিয়েছিল। সে সময় রেনকোজিতে রেখে দেওয়া ভস্ম পরীক্ষা করে তাঁরা সিদ্ধান্তে আসেন ওই ভস্ম আদৌ সুভাষ বোসের নয়। এমনকী কোনও মানুষের নাও হতে পারে। মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বোস ভারতে ফিরতে পারেন। অন্যদিকে, ১৯৪৬ সালের ব্রিটিশ নথিতে জানা গিয়েছে যুদ্ধাপরাধী বোস ভারতে ফিরলে কী কী ভাবে বিচার হবে। সিদ্ধান্তে আরও লেখা হয়েছে, তিনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকুক। তাঁকে আত্মসমর্পণ না করতে বলাই ভালো। প্রকাশিত নতুন নেতাজি ফাইলগুলি ঘেঁটে আরও স্পষ্ট হয়েছে যে সুভাষচন্দ্র রাশিয়া ও চিনে সক্রিয় ছিলেন। একাধিক বেতার ভাষণও দিতেন। কোথাও কোনও জেলে বন্দি বা হত্যা করা হয়েছে এমন বিশ্বাসযোগ্য সূত্রও মেলেনি। অনেক ফাইল রহস্যমূলকভাবে নিখোঁজ ও অসম্পূর্ণ। তাই আজও প্রত্যেক ভারতীয় জানতে চায় তাদের নেতাজির আসলে কী হয়েছিল? কেন নীরব আজও ভারত সরকার?
সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটির বক্তব্য নিয়ে গবেষকগণ বিভিন্ন দলে বিভক্ত । আমাদের এই নিবেদন কোনো ভাবেই জ্ঞানত কাউকে আঘাত করার জন্যে নয়, নেতাজির শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা মাত্র ।

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে