কলকাতার বুকে আজও অমলিন ব্রিটিশদের একমাত্র শ্মশান - শুভজিৎ দে

শ্মশান কিংবা সমাধিস্থলকে কেন্দ্র করে মানুষের কৌতূহল চিরকালীন। বিশ্বব্যাপী লৌকিক-অলৌকিক নানা গল্প জড়িয়ে থাকে এসব জায়গা ঘিরে। জড়িয়ে থাকে বহু আবেগঘন মুহূর্তও। চেনা মানুষ, প্রিয়জনের পার্থিব শরীর ধুলোয় বিলীন হওয়ার আগে শেষবার সেখানে সশরীরে দেখার সুযোগ মেলে। জানলে অবাক হতে হয়, বিশ্বজুড়ে শেষকৃত্যের ধরন সংখ্যায় নেহাত কম নয়। কখনও ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কখনও আবার নিছক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সেই সব রকমফের জন্ম নিয়েছে।

একসময়ে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় রাজারাজরাদের কফিনবন্দি দেহের মধ্যে ওষুধ মাখিয়ে রাখা হত পিরামিডের অভ্যন্তরে। সেই দেহ অবিকৃত থাকত বছরের পর বছর। আবার খাস কলকাতার বুকেই ছিল পার্সিদের ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’। প্রাচীন পারস্যের মানুষ ছিল অগ্নির উপাসক। প্রাচীন ইরানিরা মনে করত, মৃত্যুর পর দেহ আগুন কিংবা মাটির সংস্পর্শে এলে অপবিত্র হয়। তাই শেষকৃত্যের অন্য উপায় ভাবতে হবে। সেখান থেকেই ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’-এর ভাবনা। খোলা আকাশের নীচে অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরি করা হত এক গোল মিনার। তার উচ্চতা ছিল দোতলা কিংবা তেতলা বাড়ির সমান। সেই মিনারের চওড়া ছাদে রেখে আসা হত মৃত মানুষের দেহ। এর পর কাক, চিল, শকুন ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত দেহগুলি।  সৌধের মধ্যে নশ্বর দেহগুলি শকুন, বাজপাখিদের সেবায় লাগানোকেই পবিত্র বলে মনে করত পার্সিরা। বিশ্বজুড়ে বহু শহরে তারা এই ধরনের সৌধ গড়ে তুলেছিল যার কিছু কিছু এখনও বর্তমান। খাস কলকাতায় ছিল তেমনই এক সৌধ। যদিও বেলেঘাটা মেইন রোডের সেই সৌধটি বহু বছর অব্যবহৃত। কলকাতায় বসবাসকারী পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা বর্তমানে ৪০০-য় ঠেকেছে। তারাও পুরনো আচার মতে শেষকৃত্যের ধরন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে বহুদিন। 

বর্তমান ভগ্নপ্রায় অবস্থা 

আর একদিকে ব্রিটিশ-খ্রিস্টানদের দেহ সৎকারের জন্য শ্মশান চালু ছিল কলকাতায়। কালের আবর্তে এখন তা শুধুমাত্র একটি দণ্ডায়মান ইতিহাস বহনকারী ঔপনিবেশিক ইমারত মাত্র। আমরা যারা ঐতিহ্যশালী সাউথ পার্কস্ট্রিট ও লোয়ার সার্কুলার রোড সেমিট্রির কথা জানি, তারা অনেকেই এই শ্মশানের সঙ্গে অপরিচিত। নিছক কৌতূহল মেটাতেই সেদিন গিয়ে পড়লাম এই ইতিহাসের সম্মুখীন হতে। 

CHRISTIAN GAS CREMATORIUM 

মৃত্যুর পর খ্রিস্ট ধর্মালম্বী মানুষের দেহ সমাধিস্ত করার বদলে দাহ করার ঘটনা ব্যতিক্রম হলেও বিরল নয়। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, মধ্যযুগীয় যুদ্ধ কিংবা মহামারির মাঝে বহু নিথর দেহের সতগতি করার উদ্দেশ্যে বেছে নেওয়া হত দাহ প্রক্রিয়া। মূলত একসঙ্গে মৃতদেহের থেকে যাতে রোগ না ছড়ায়, সেই জন্যই এই কাজ করা হত। সমাধিস্ত করলে মাটির নিচ থেকেও রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যেত না। ব্রিটিশ আমলে কলকাতাও সাক্ষী থেকেছে খ্রিস্টদের দাহকার্যের। তবে তা কোনও বিজ্ঞানভিত্তিক বা ধর্মীয় কারণে নয়, নেহাত বাণিজ্যক স্বার্থে। সেই সময়ে কলকাতায় ব্রিটিশদের কবরস্থান হিসেবে ছিল লোয়ার সার্কুলার রোড সেমিট্রি এবং সাউথ পার্কস্ট্রিট সেমিট্রি। তাহলে কথা হচ্ছে, কলকাতায় এমন প্রথার প্রচলনের দরকার পড়ল কেন?

অন্যান্য দেশেও এই রকম গ্যাস চুল্লি

প্রাণবিয়োগের পরে স্বদেশের মাটিতেই প্রিয়জনকে সমাধিস্থ করা পবিত্র বলে মনে করত তৎকালীন ব্রিটিশরা। এবার ধরা যাক, কোনও ইংরেজ সাহেব বা কর্মচারী যিনি কর্মসূত্রে কলকাতায় রয়েছেন এবং এখানে থাকাকালীনই তিনি গত হলেন। এবার সেই মৃতদেহ বিদেশে পাঠানো যেমন খরচ ও সময় সাপেক্ষ, তেমনই যাত্রাপথে শবদেহ নষ্ট হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনাও ছিল। আবার অন্যদিকে তখন ভারতীয়দের আন্দোলনের জেরে জেরবার তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। এত ঝক্কি সামলে মৃত কর্মচারীর দেহ ইংল্যান্ডে পাঠানোর কথা মাথায় আসতেই চোখে সর্ষেফুল দেখছিলেন ব্রিটিশ সরকার। এই সমস্যার সমাধান নিয়েই এগিয়ে এলেন খ্রিস্টান বারিয়াল কমিটি। তারাই সমাধান দিলেন, যদি পার্থিবদেহ এখানেই দাহ করা হয়, এবং তার একটা অংশ (চিতাভষ্ম) যদি তার পরিজনরা নিয়ে গিয়ে স্বদেশের মাটিতে কবরস্থ করেন, তাহলে কিন্তু সব দিক রক্ষা হবে। যদিও এই সমাধান নিয়ে বিশেষ কিছু চিন্তা ভাবনা করতে হয়নি ইংরেজ সরকারকে, বাণিজ্যিক কূটবুদ্ধি সম্পন্ন মাথাগুলি খুব সহজেই আর্থিক লাভের অঙ্কটা বুঝে গিয়েছিলেন বারিয়াল কমিটির দেওয়া ওই প্রস্তাবে। তাই শেষমেশ ঠিক হল, এ দেশে কর্মরত যে সকল ইংরেজ কর্মচারী এ দেশের মাটিতে মারা যাবেন এবং তাঁর পরিবার যদি দেহ স্বদেশে নিয়ে গিয়ে কবরস্থ করতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদের সেই কর্মচারীর চিতাভষ্ম নিয়েই যেতে হবে। অন্যথায় এ দেশেই সেই কর্মচারীকে সমাধিস্থ করতে হবে। আর এই ভাবনা থেকেই কলকাতায় খ্রিস্টানদের সমাধিস্থ করার স্থান থাকলেও জন্ম নিয়েছিল ‘Christian Gas Crematorium’-এর।

এই শ্মশানটি বানানো শুরু হয় ১৯০৪ সাল নাগাদ, আর এই শ্মশানে শবদাহ শুরু হয় ১৯০৬ সালের শুরুর দিকে। যদিও আমার-আপনার চেনা কাঠের চুল্লির মতো কিন্তু এই শ্মশান নয়, এটি ছিল সম্পূর্ণ গ্যাস নিয়ন্ত্রিত একটি চুল্লি। যার জন্য এর নামও দেওয়া হয় ‘Christian Gas Crematorium’। এর থেকেই শ্মশানের সামনের রাস্তার নাম হয় - Crematorium Street।

CREMATORIUM Street এ অপেক্ষারত 

যদিও এখানে ব্রাহ্মদেরও দাহ করা হত, কারণ অনেক ব্রাহ্ম চাইতেন না গঙ্গাতীরে তাদের শবদাহ করা হোক। আর তাদেরও শবদাহ করার পর চিতাভষ্ম নিয়ে তা সমাধিস্ত করতেন তাঁর পরিবার-পরিজন। অনেক ক্ষেত্রে এ-ও দেখা গিয়েছে যে, যারা এদেশীয় ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান, তারাও চাইতেন তাদের শব প্রথমে দাহ করা হোক, এবং পরে তা সমাধিস্থ করা হোক।

বেদীযুক্ত বারান্দা

এই শ্মশানটিকে বর্তমানে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে কোনও পরিত্যক্ত খ্রিস্টান উপাসনালয়। যে কারণে এমন মনে হবে আদতে তা একটি চিমনি, যার অবস্থান হলঘরের ঠিক উপরে, এই হলঘরের সামনে একটি ছোট বারান্দা আছে এবং তা একটি ছোট বেদী যুক্ত। যেখানে ‘শব’ চুল্লিতে ঢোকানোর আগে সেই বেদীতে রাখার ব্যবস্থা করা হত, যদি কেউ শেষ শ্রদ্ধা জানাতে চায় সেই ভেবে। চুল্লিটি বানিয়ে ছিল একটি ফরাসি কোম্পানি, নাম ‘Toisul Fradet & Co.’, যাদের খ্যাতি সেই সময় আকাশচুম্বী ছিল এই ধরণের গ্যাস চুল্লি প্রস্তুত করার জন্য। প্রায় ১০ ফুট লম্বা এই চুল্লির দুইদিকেই দরজা আছে এবং একটি সিঁড়ির মতো দেখতে ধাতব অংশের মাধ্যমে মৃতদেহ চুল্লিতে ঢোকানো হত। চুল্লিতে গ্যাস পাইপের অনেক সংযোগস্থল আছে। শবদেহ দাহ হওয়ার সময় চুল্লির ভিতরের অবস্থা দেখার জন্য চুল্লির বাইরের গায়ে দুইদিকে বেশ কিছু ঢাকনা দেওয়া ছিদ্র আছে, যেগুলির মাধ্যমে সম্পূর্ণ দাহ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হত।

প্রস্তুতকারী সংস্থা

এই গ্যাসচুল্লি শুরু হওয়ার পর, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এক বিশেষ সূত্র থেকে জানা যায়, প্লেগ আক্রান্ত বেশ কিছু ইংরেজ কর্মচারীকে সেই সময় এখানে দাহ করা হয়েছিল, পরবর্তীকালে স্থানীয় মানুষদের চাপে তা বন্ধ হয়। তবে এই তথ্যের সত্যতার কথা ‘খ্রিস্টান বুরিয়াল কমিটি’ কিন্তু স্বীকার করে না। 

গ্যাস চুল্লি 

তাদের থেকে জানতে পারি, এই গ্যাসচুল্লিতে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুকে দাহ করা হয়, যেহেতু তিনি ব্রাহ্ম ছিলেন। দীর্ঘ ৭৪ বছর ঠিকঠাক ভাবে শবদাহ হওয়ার পরে শেষে ১৯৮০ সাল নাগাদে এই গ্যাসচুল্লিটি বন্ধ হয়ে যায়।


গ্যাস চুল্লির ভিতরের অংশ

কারণ হিসেবে খ্রিস্টান বারিয়াল কমিটি জানায়, মূলত অনিয়মিত গ্যাস জোগানের ফলে এবং কলকাতায় সেই সময়ে এক বন্যার কারণে এই চুল্লিটি পরিত্যক্ত হয়। এখানে প্রবেশের জন্য খ্রিস্টান বারিয়াল কমিটির অনুমতির দরকার হয়, তবে বর্তমানে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

দাহকার্য পর্যবেক্ষণের জন্য ছিদ্র

লোয়ার সার্কুলার রোড সেমিট্রি ছেড়ে, শিয়ালদহর দিকে এগোতে গিয়ে সেমিট্রির পাঁচিল ঘেঁষে যে রাস্তাটি গেছে, তা ধরে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই একটি তিন মাথার মোড় আসে। সেখান দিয়ে ডানদিকের রাস্তা ধরে আরও দু’মিনিট হাঁটলেই চোখে পড়বে ‘Christian Gas Crematorium’-এর বন্ধ গেট। যে গেট হাজার হাজার প্রিয়জনের ক্রন্দনরত হৃদয়ের সাক্ষী থেকেছে সাত দশক ধরে। সে দেখেছে মহান বিজ্ঞানীর নশ্বর দেহ আর বদলে যাওয়া তিলোত্তমার রূপ। এই বৈচিত্র্যের শহরে ইতিহাসের জীবন্ত দলিলকে পিছনে রেখে আমি ফিরে চললাম বাড়ির দিকে। উদাসী বিকেলে আমায় নিস্তব্ধ বিদায় জানাল কলকাতার বুকে ব্রিটিশদের একমাত্র শ্মশান।


তথ্যসূত্র:

1. Indianvagabond.com 

2. Telegraphindia.com

3. Christainburialboardkolkata.com

4. Salilhore.wordpress.com

5.WIKIPEDIA 

চিত্রঋণ -  Christian Burial Board Kolkata

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে