অতীতের রত্নচক থেকে বর্তমানের পাথরা : এক নিশ্চিত মৃত্যু থেকে উৎরে যাওয়ার কাহিনী - শুভজিৎ দে
অনেকদিন আগে থেকেই ঠিক ছিল মন্দির শহর পাথরা ঘুরতে যাওয়ার, কিন্তু বাধসাধে লকডাউন, তাই নতুন বছরের প্রথম ভ্রমণ এখান থেকেই শুরু করার একটা সুপ্ত ইচ্ছা ছিল মনে মনে, আর সেই মোতাবেক সন্ধান শুরু করি এখানে পৌঁছাবো কি ভাবে ! প্রথমেই বলি মন্দির শহরের থেকেও বেশী গ্রামটির নাম আমায় আকর্ষণ করেছিল, আমার মনের ভিতর জন্ম দিয়েছিল নানা ধরনের প্রশ্নের। জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি গ্রামটির আদিনাম রত্নচক বা রতনচক সেখান থেকেই আজকের পাথরা, তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক এমন নামকরণের ইতিহাস।
পাথরা মন্দির শহরের বর্ণনা জনার আগে পাথরার নামকরণের পটভূমি জানা দরকার, খ্রিঃ ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে রচিত 'আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থ থেকে জানা যায় সমকালীন ওড়িশা পাঁচটি সরকারে বিভক্ত ছিল, যার অন্যতম সরকার জলেশ্বরের অধীনে। যেখানে মেদিনীপুর জেলার সমগ্র অংশ ছিল, আর সেই মেদিনীপুর জেলা 120টি পরগণা নিয়ে গঠিত হয়েছিল, বলা যেতে পারে রত্নচক পরগণা ঐ 120টি পরগণার একটি। এছাড়াও জানা যায় যে, মেদিনীপুর জেলার এই এলাকাটি তাম্রলিপ্ত বিভাগের অন্তর্গত ছিল। 1971 সালের মেদিনীপুর জেলা হ্যান্ডবুক থেকে জানা যায় যে, 120টি পরগণা নিয়ে মেদিনীপুর জেলা গঠন করা হয়েছে, আবার যোগেশচন্দ্র বসু রচিত মেদিনীপুরের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে 54টি পরগণার কথা।
এদিকে মেদিনীপুর জেলার বাইরে, ইতিহাসের নদীতে বয়ে গেছে সময়ের অনেক জল, দিল্লীর সাথে সাথে বাংলায়ও ক্ষমতার পরিবর্তন এসেছে, এই সময়ই মুর্শিদকুলির বংশের শেষ নবাবকে পরজিত করে বাংলার নবাব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন আলিবর্দি খা। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ রাঢ় ভূমির অংশ এই রত্নচক, যা ছিল উর্বর কংসাবতী নদিকূলবর্তী অঞ্চল। প্রধানত কৃষিনির্ভর এলাকা, এই পরগণার আয়তন ছিল 1 লক্ষ 86 হাজার 300 বিঘার মতো (প্রায়)
বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে আলিবর্দি খা ছিলেন সর্বধর্ম প্রিয় সুবেদার, খাজনা আদায়ের জন্য পরগণার অধীনস্ত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শিক্ষিত ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেছিলেন বলে সাক্ষ পাওয়া যায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রত্নচক পরগণার নায়েব নিযুক্ত হন বিদ্যানন্দ ঘোষাল। দায়িত্বশীল নায়েব হিসেবে বিদ্যানন্দের কর্তব্যে রত্নচক পরগণার প্রজাদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে, বাংলার সুবেদারের রাজকর্মচারীরা এই নায়েবকে ভালোচোখে দেখতেন না। অন্যদিকে বিদ্যানন্দ ছিলেন ধর্মপ্রাণ হিন্দু, রত্নচকে সপরিবারে থিতু হয়ে ঠিক করলেন এখানে তিনি মন্দির বানাবেন, যেমন ভাবা তার তেমন কাজ, একের পর এক মন্দির নির্মাণ করতে শুরু করলেন তিনি। অতীতের সেই নিদর্শন গুলি আজও সাক্ষ বহন করে চলেছে,
যেমন ভগ্ন কাছারি মহল, ঠাকুর দালান, রাসমঞ্চ, মন্দির প্রভৃতি। বিদ্যানন্দ এসব করেও থামলেন না, ইতিমধ্যে 200'র কাছাকাছি মন্দির নির্মাণ করে ফেলেছেন তিনি, যেখানে 86টি শিবমন্দির, আর যদি 14টি শিবমন্দির নির্মাণ করতে সফল হন তিনি তবে রত্নচক ও কাসীধাম হয়ে উঠবে, এই ছিল তার মনের ইচ্ছা। কিন্তু সেই স্বপ্ন সত্যি হবার আগেই ঘটে বিপত্তি, আলিবর্দি খাঁর কাছে কেউ যেন বিদ্যানন্দের নামে কানভারি করে এই বলে যে তিনি (বিদ্যানন্দ) নাকি তহবিলের টাকা থেকে একের পর এক মন্দির বানিয়ে চলেছেন। এই সব শুনে পরিষদদের কাছ থেকে নবাব বিদ্যানন্দকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন, সে সময় এই আদেশ পালন হত মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তিকে হাত পা বেধে পাগলা হাতির গতিপথে ফেলে দেওয়ার মাধ্যমে। সেইমত রত্নচকে পাগলা হাতি এলো, সিপাই-সামন্ত এলো, আর নবাবের নির্দেশ মত যতোবার বিদ্যানন্দকে হাত পা বেধে পাগলা হাতির গতিপথে ফেলা হয়, ততবারই গজরাজ তাঁকে এড়িয়ে চলে যায়, আর এই ঘটনা একবার, দুইবার নয়, বারবার হয়। নবাবের কর্মচারীরাও সব স্তম্ভিত, বিদ্যানন্দ সেবার রেহাই পেলেন হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে, বিদ্যানন্দ মৃত্যু থেকে উৎরে যাওয়ায় নবাব তাঁকে এই পরগণার নায়েব থেকে জমিদারের মর্যাদা দেন।
আর এই পা-উৎরা ( হাতির পা থেকে উৎরে যাওয়া বা রেহাই পাওয়া ) থেকে গ্রামের নাম হয় পাতরা, কালের নিয়মে অপভ্রংশ হয়ে আজকের পাথরা। তবে এই নামকরণ নিয়ে বিতর্ক আছে, অনেকে মনে করে থাকেন বিদ্যানন্দের দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান রত্নেশ্বর ঘোষাল রত্নচক পরগণার নাম পরিবর্তন করে রাখেন পাতরা, তার বাবার মৃত্যুর পর, বিদ্যানন্দের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। যা আজকে পাথরা নামে পরিচিত, এবং ঐতিহাসিক গবেষকদের মনে এখন ও যা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়ে চলেছে। এক প্রখ্যাত গবেষক বলছেন - " পাথরা-আড়া অর্থাৎ পাথর পাওয়া যায় এমন স্থান থেকেও এই নামের উৎপত্তি হতে পারে।" কিন্তু বর্তমনে এই এলাকাতে পাথরের খনি, বা ঢিবির কোনো দেখা মেলেনি, কংসাবতী নদীকে পাশে রেখে পূর্বমুখী মন্দিরগুলি যেগুলিকে সংরক্ষণ করা গেছে তা আজও বর্তমান।
পাথরার যে 34টি মন্দির এখনও ধুঁকতে ধুঁকতে টিকে আছে তার অধিকাংশই আজ বিগ্রহহীন, শিল্পরসিক চোরেদের হাতে পড়ে পাথরার টেরাকোটা আজ বিপন্ন, যতটুকু জীবিত আছে তা ঐ বাজার পাড়া অঞ্চলে, 250 বছর আগে বাজার পড়া জমজমাট গঞ্জ, কোলাহল মুখর রাজপ্রাসাদ, ল্যাটেরাইট পাথরের বিশাল দূর্গামন্ডপ, পুজোর সময় 100টা পাঁঠা আর মোষ বলি হত এক সময়ে। দেবীর চরণ রক্তস্নাত হয়ে নালা দিয়ে সেই রক্তের জোয়ার রাঙিয়ে তুলত কাঁসাই নদীকে। বেশ কিছু আটচালা, চারচালা শিবমন্দির এই বাজার পাড়ায়, দুই শতাব্দী ধরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা মন্দির গুলির বেশ কিছু আজ বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। আবার কয়েকটির সলিলসমাধি হয়েছে নদীর বাঁধের নীচে চাপা পড়ে থাকা কোনো সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের মত। সংরক্ষণ ও সঠিক নজরদারির অভাবে স্থানীয়রা বা পর্যটকেরা অনেকেই এসে এখানে তাদের অর্থাৎ মন্দিরের গায়ে তাদের প্রেমের চিহ্ন অঙ্কন করে গিয়েছেন, যা মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবকে তুলে ধরে।
পাথরা ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্রের মর্যাদা পেলেও আজও সে অবহেলিত, তবুও সাম্প্রদায়িক চোখরাঙানিকে শিকেয় তুলে বিদ্যানন্দের পাথরাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন মহম্মদ ইয়াসিন পাঠন, মাত্র 17 বছর বয়েসে কয়েকজনকে রাস্তা দেখিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় তার এই সংরক্ষণ অভিযান, ষাটোত্তীর্ণ হয়েও আজও তিনি সেই 17 বছরের যুবকের উদ্দমেই এই অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সম্পর্কে যাই বলা হয় তা কমই হবে। শেষে একটাই কথা বলি, আসুন একটা হারিয়ে যাওয়া লুপ্তপ্রায় সভ্যতা ও সংস্কৃতির চিহ্নকে সম্মান জানাই, এ যেন 250 বছর আগের রত্নচক পরগণার এক মুসমাদারের (উর্দু ভাষায় নায়েব) কাতর আবেদন। আর রত্নচক থেকে পাথরা হয়ে ওঠা এ যেন এক কিংবদন্তি ইতিহাস, যা লোকমুখে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঘুরে বেড়াবে।
পথনির্দেশিকা: মেদিনীপুর শহর থেকে 14 কিমি দূরে “পাথরা”। মেদিনীপুর বা খড়গপুর থেকে যেকোনো ভাবে আমতলা, সেখান থেকে অটোতে হাতিহালকা গ্রাম, এখান থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ।
তথ্যসূত্র -
1. মন্দিরময় পাথরা'র ইতিবৃত্তি - মহম্মদ ইয়াসিন পাঠান
2. মন্দিরময় পাথরা - তারাপদ সাঁতরা
3. মোল্লার দৌড় মসজিদ নয় - দেবারতি মুখোপাধ্যায়
4. সংবাদ প্রতিদিন পত্রিক (3-9-1999)
5. আনন্দবাজার পত্রিকা (23-3-2020)
6. INTERNET
Comments
Post a Comment
If you have any doubt, please let me know.