ইতিহাস প্রসঙ্গে - শুভজিৎ দে

মানুষের জীবন বহুমুখী, কখনো সে রাজনীতির দোরগোড়ায়, কখন বা বাঁচার তাগিদে বা ভোগের প্রলোভনে অর্থ উপার্জনে ব্যাস্ত হয়ে পরে. কখন যে সংস্কৃতি চর্চা করে আবার কখনো বা সমাজের আর পাঁচজনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে, আবার কখনো কখনো ঐহিক সুখ ছেড়ে মানুষ আধ্যাত্মিক পথে পা বাড়ায়, মানুষ তথা মনুষ্য সমাজের বিচিত্র গতি প্রকৃতির বর্ণনা ও বিশ্লেষণ হলো ইতিহাস, ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে ইংরেজি "HISTORY" শব্দটির প্রসঙ্গ ওঠা স্বাভাবিক, সাধারণ ভাবে আমরা ইংরেজি শব্দ "HISTORY" অর্থে ইতিহাস ব্যবহার করে থাকি, ইংরেজি "HISTORY" শব্দের মূল অর্থ অনুসন্ধান বা গবেষণা, সেই অর্থে "ইতিহাস" ও "HISTORY" শব্দদুটি ঠিক এক নয়, ইংরেজি "HISTORY" গ্রীক "HISTORIA" শব্দ হতে উদ্ভূত, আবার লাতিন শব্দ "HISTOR"(হিস্টর) থেকে "HISTORY" বা "হিস্ট্রি" শব্দটি এসেছে, “HISTOR”(হিস্টর) কথার অর্থ হলো জ্ঞান, উল্লেখ্য গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস 'হিস্ট্রি' শব্দটি প্রথম  ব্যবহার করেছিলেন এবং তারপর ধীরে ধীরে এর বহুল ব্যবহার শুরু হয়,



ইংরেজি "হিস্ট্রি" শব্দটির  মতো "ইতিহাস" শব্দটিও অতি প্রাচীন, ওই শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় "অথর্ব বেদ", সেখানে 'ইতিহাস' কে উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে “অথর্বেদেতিহাসবেদৌ চ বেদা:”, সেখানে 'ইতিহাস' শব্দটি প্রথম পাই সংষ্কৃত ভাষায় তবে মনে রাখা দরকার তখনকার ইতিহাস সংক্রান্ত ধারণার সঙ্গে বর্তমানের ইতিহাস ধারণার সাদৃশ্য খুব বেশ নেই, কারণ তখন কার ইতিহাস ছিল পুরান নির্ভর,



(অথর্ববেদ হিন্দুধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মগ্রন্থ বেদের চতুর্থ ভাগ। অথর্ববেদ’ শব্দটি সংস্কৃত (দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রণালী) বেদ(জ্ঞান) শব্দদু-টির সমষ্টি। অথর্ববেদ বৈদিক সাহিত্যের পরবর্তীকালীন সংযোজন অথর্ববেদ ২০টি খণ্ডে বিভক্ত। এই গ্রন্থে ৭৩০টি স্তোত্র ,০০০ শ্লোক আছে। প্যাট্রিক অলিভেল অন্যান্য গবেষকদের মতেএই গ্রন্থ বৈদিক সমাজের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পর্কিত মতবিশ্বাস আচার-অনুষ্ঠানের ঐতিহাসিক সংকলন। এটি যজুর্বেদের মতো শুধুমাত্র একটি ধর্মানুষ্ঠানবিধির সংকলন নয়।)
   
এখন আসা যাক ইংরেজি "HISTORY" এবং আমাদের বহুল ব্যবহৃত 'ইতিহাস' শব্দ ও  বিদ্যাগুলির  মধ্যে  সাদৃশ্য   বৈসাদৃশ্য প্রসঙ্গে, এ কথা সর্বজনবিদিত যে, অতীতের কোনো বিষয় বা ঘটনা, তা সামাজিক,অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সংস্কৃতিক যাই হোক না কেন, সে সম্পর্কে আলোচনা ও চর্চার জন্য যে বিদ্যা আমরা অধ্যয়ন করি তা ভারতবর্ষে বাংলা ও অন্যান্য কয়েকটি ভাষায় ইতিহাস নামে পরিচিত, 'ইতিহাস' নামক গ্রন্থটি ইংরেজি "HISTORY" নামক বিদ্যাটির সাথে অভিন্ন বলেই ধরা হয়, কারণ দুটি বিদ্যার উদ্দেশ্য চর্চার ধারা প্রায় এক, এখানে অবশ্য উল্লেখ করা আবশ্যক যে ইংরেজি "HISTORY" শব্দটির  নিছক অনুবাদ 'ইতিহাস' নয়, অতঃপর আধুনিক কালে 'হিস্ট্রি' 'ইতিহাস' এর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই, বস্তুতআধুনিক কালের হিস্টরী বা ইতিহাস তথা অতীত চর্চার সাথে প্রাচীন ভারতের অতীত তোহা ইতিহাস সংক্রান্ত  চিন্তা ধারায় মূলগত পার্থক্য রয়েছে, কেন না , বর্তমান যুগে অতীত কে অনুধাবন করার জন্য যে সব পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হয় যেমন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমা, কালানুক্রম, নির্ভরযোগ্য তর্থ বা আকর, উপাদানের বিচার বিশ্লেষণ প্রভৃতি সেগুলি প্রাচীন ভারতে অতীত তথা ইতিহাস চিন্তায় ছিল প্রায় অনুপস্থিত, 

ইতিহাস শব্দটি ভাঙলে দাঁড়ায় 'ইতি--আস' এর অর্থ হল "এইরূপ ছিল" বা  "ঘটে ছিল" , অর্থাৎ ইতিহাসের কারবার অতীত কে নিয়ে, সেই অতীত বহুকাল আগের হতে পারে, আবার কিছুকাল আগেও হতে পারে, কিন্তু মনে রাখা দরকার সব অতীত ঘটনাই কিন্তু ইতিহাস নয়, বস্তুত: অতীত ইতিহাস বিষয়ক অতীতের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য থাকা বাঞ্ছনীয়আসলে সংশ্লিষ্ট বিষয় বা ঘটনাকে ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্ব পূর্ণ (HISTORICALFACT) হতে হয়এডওয়ার্ড হ্যালেট কার যথার্থই বলেছেন,  ইতিহাস হল " অতীত  বর্তমানের মধ্যে অন্তহীনকথোপকথন"  (Endless conversations between past and present)


                      ( Edward Hallett Carr)                                    

Comments

Popular posts from this blog

সহজ পাঠ ও রবীন্দ্রনাথের অবনির্মান - শুভজিৎ দে

দেশীয় রাজ্যগুলির ভারত ভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক - শুভজিৎ দে

পতিতাবৃত্তির জন্ম ও বিবর্তন - শুভজিৎ দে